রথযাত্রা মানব জীবনের সফর কথা বলে। ভক্তের সফর আরাধ্যের কাছে পৌঁছানো তার লক্ষ্য। রথের আসীন প্রভু দারুদেব যেন নেমে আসেন ভক্তের মাঝখনাটিতে। উচ্চ-নীচ, আপন পরের ভেদ তাঁর কাছে নেই। তাই নিমাই সন্ন্যাসী যেমন তাঁর আপনার জন, তেমনি তাঁর মহাভক্ত হয়ে ওঠে সালাবেগ।
কিন্তু কে সেই ভক্ত সালাবেগ?
জগন্নাথের চরণের দাসানুদাস ভক্ত সালাবেগ। তাঁকে জানতে চাইলে ফিরতে হবে সতেরোশো শতাব্দীতে। স্বভাবে কবি। ধর্মে যবন। ওড়িয়া ভাষায় প্রভু জগন্নাথকে নিয়ে পদ লিখেছিলেন। তাঁর বাবা লালবেগ আকা ছিলেন জাহাঙ্গীরের সুবাদার। সেই সূত্রেই তাঁরা ওড়িশাবাসী।
একবার লালবেগ তাঁর পুত্রকে আফগানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠান। গুরুতর যখন হয়েছিলেন সালাবেগ। তখন তাঁর পালিতা মা লালবিবি তাঁকে জগন্নাথের নাম জপ করতে বলেন। পুত্রকে এক সাধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সালাবেগ ভাল হয়ে যান। সেই থেকে তাঁর মধ্যে জগন্নাথপ্রেম জন্ম নেয়।
ধীরে ধীরে সালাবেগ রামায়ণ, মহাভারত পাঠ করতে শেখেন। কিন্তু তাঁর এহেন আচরনে ক্ষুন্ন হয়ে আত্মীয়রা মাতা-পুত্রকে পরিত্যাগ করে।
কাহিনি বলে এরপর সালাবেগ মাকে নিয়ে শ্রীক্ষেত্র আসে। কিন্তু সেখানেও প্রবেশ নিষেধ। তাঁরা তখন বৃন্দাবনে যান। কৃষ্ণধামে পদাবলী পাঠ শিখে আবার পুরী ফেরায় মনস্থির করেন।
একবার উল্টোরথের আগে পুরী ফিরবেন বলে রওনা হন কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে আটকে যান।
সেবার জগন্নাথের রথও পথ মধ্যে আটকে যায়। কোনওভাবেই নড়ানো যায় নান্দী ঘোষকে। সেই সময় মন্দিরের এক পুরোহিত জানান তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন যতক্ষণ না ভক্ত সালাবেগ আসবে ততক্ষ্ণ প্রভুর রথ নড়বে না।
দুর্যোগ শান্ত হওয়ার পর সালাবেগ এসে পৌঁছালে তবেই রথ ফের যাত্রা শুরু করে। ধন্য ধন্য করে সবাই। এমনকি রাজাও প্রশংসা করে তাঁর।
সালাবেগকে নিয়ে আরও একটু কাহিনি প্রচলিত আছে।
সেই কাহিনি অনুযায়ী, একবার সালাবেগ রথদর্শন করতে গিয়ে পড়ে গেলেন ভিড়ের মাঝখানে। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে পায়ের চাপে পরিত্রাহী পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে জখম হলেন ভীষণভাবে। মনে মনে সালাবেগ বলতে লাগলেন, প্রভুর রথযাত্রা দর্শন কী তাহলে তাঁর আর হবে না? প্রভু কী তাঁর জন্য একটু অপেক্ষা করতে পারে না?
গোটা বিশ্বের যিনি ঈশ্বর তিনি অপেক্ষা করবেন সালাবেগের জন্য, তা কি হয়!
রথের রশিতে টান দিলেন ভক্তরা। কিন্তু বড় ডান্ডায় আটকে গেল প্রভু জগন্নাথের রথ। একটুও গড়ন হল না গুন্ডিচার দিকে। রাজাও ব্যর্থ হলেন।
তখন এক পুরোহিত জানান, তিনি রাতে স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন জগন্নাথের প্রিয় ভক্ত স্লাবেগ না এলে রথ চলবে না।
তখন সালাবেগের খোঁজ পড়ে সর্বত্র। সালাবেগ এলে তবেই চলতে শুরু করে রথ।
সালাবেগ যবন হওয়ায় তাঁর জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশে নিষেধ ছিল। পুরীর সমুদ্রতীরে আখড়া বানিয়ে তিনি জগন্নাথ প্রভুর নামগান করতেন। ভক্তরা তাঁকে দেখতে আসতেন। সমুদ্র তীরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। জগন্নাথের এই মহা ভক্তকে সমুদ্র তীরেই সমাধি দেওয়া হয়।
আজও রথের দিন বড় ডান্ডায় কিছুক্ষ্ণের জন্য থমকে থাকে শ্রী জগন্নাথের রথ…