ভাইফোঁটার গল্প

যম আর যমুনা। সোদর ভাইবোন। ভাইফোঁটার দিন ছড়া কেটে যমুনা আজও ভাই যমের কপালে ফোঁটা দেন। আমাদের আজন্ম তাই বিশ্বাস। কিন্তু, যম-যমুনার মতো সবার কী আর ভাই থাকে, নাকি সবার বোন থাকে নিজের! আমার সেজোদাদুরই ছিল না। শুধু তাই নয়, একটা মাসতুতো বোন, মামাতো বোন, মায় পিসতুতো বোনও ছিল না। এমন কপালও মানুষের হয়! হয় হয়। তবুও সে-কপালে ফোঁটা পড়ত ফি বছর। কেমন করে? সেও আসলে এক গপ্পো।

সেজদাদু তখন এইটুকুনি, পুঁচকে একটি বাচ্চা। বছর পাঁচেক বয়স। এক্কেবারে ছোটবেলায় পাড়ার বন্ধুদের  ভাইফোঁটা নিতে দেখে সেজোদাদুর সে কী কান্না,  এক্কেবারে আছাড়িপিছাড়ি কান্না, কিছুতেই আর থামানো যায় না! তাঁর একটাই গোঁ, ভাইফোঁটার ফোঁটা চাই এবং এক্ষুনি চাই! বোনই নেই, ফোঁটা দেবে কে? সেজোদাদুর মা কিছুতেই আর সে-কথা ছেলেকে বুঝিয়ে উঠতে পারেন না। বোঝাবেন কী করে, শিশুমনের না-পাওয়ার বেদনা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কী আর ভোলানো যায়! উপায় না-দেখে সেজোদাদুর মা তখন পাড়াতুতো বোনদের কাউকে ডেকে আনতে  বেরুলেন। সেই দুপ্পুর বেলা নিজের ভাইকে ফোঁটা দিয়ে হয় কেউ উপোষভঙ্গ করে ফেলেছে, নয় কেউ নিজের ভাইকে তখনো ফোঁটাই দিয়ে উঠতে পারেনি। তা, নিজের ভাইকে ফোঁটা না-দিয়ে তারা অন্যকে ফোঁটা দিতে আসে কেমন করে!  

সেজোদাদুর ঠাকুমা নদীতে গিয়েছিলেন স্নান করতে। তিনি একাহারী মানুষ, এসে শুনলেন খোকার আবদার (সেজোদাদুকে সবাই 'খোকা' বলেই ডাকত, ভালো নাম ছিল 'দীনবন্ধু')। খোকা তখন উঠোনের ধুলোয় লুটোপুটি। ঠাকুমা এসেই কোলে তুলে নিলেন তাঁর আদরের খোকাকে। আদর করে চুমু খেয়ে বললেন, 'কী হয়েছে আমার ভাইটার, হ্যাঁ? ফোঁটা নিবি? ওলে বাবালে, তার জন্য বুঝি এত কান্না? কাঁদে না, আমি দেব তোকে ফোঁটা, তুই তো আমারই ভাই। কেমন? ছোট্ট ভাইটা আমার। ও বড় বউ ভাইয়ের জন্য ভাত বাড়, চন্দনের পিঁড়ি পাত...'।

ঠাকুমা নিজের হাতে চন্দনপিঁড়িতে চন্দন ঘষতে বসলেন। সেজোদাদুর মা পেতলের থালায় ধান-দুব্বো-শাঁখ সাজিয়ে দিলেন। আসন পেতে রাঁধা ব্যঞ্জন সাজিয়ে ভাত বাড়লেন। আর আনলেন ঘরে তৈরি গাওয়া ঘি। খুশিতে ডগমগ হয়ে তখন ধুতি শার্ট পরে পাতলা চুলে টেরি কেটে পাতা আসনে এসে বসলেন সবার আদরের খোকা। ঠাকুমা কড়ে আঙুল চন্দনে ডুবিয়ে যমের দোরে কাঁটা পুঁততে 'ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা' ছড়া কাটতে কাটতে খোকার কপালে ফোঁটা এঁকে দিলেন তিনবার। তারপর ধান-দুব্বো দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। শাঁখ বাজাতে বাজাতে মা খোকাকে ইশারা করলেন প্রণাম করতে। খোকা ভারি চালাক, অমনি ঢিপ করে প্রণাম করে ফেললেন ঠাকুমার পায়ে। তাই দেখে ঠাকুমার সে কী আনন্দ! 'ও বড় বউ তোর ছেলের তো দেখছি খুব বুদ্ধি হয়েছে!' অমনি 'বেঁচে থাক ভাই বেঁচে থাক, তোর একশ বচ্ছর পরমাই হোক' বলতে বলতে চুমু খেয়ে খুব আদর করে দিলেন। তারপর খোকাকে হাত পাততে বলে তাতে ঘি ঢাললেন, বললেন সেটুকু খেতে। এমনি করে তিন বার ঘি ঢাললেন। তারপর বললেন, 'এবার তুই ভাত খা ভাই, আমরা বসে বসে দেখি। ও বড় বউ, ছোট আয় এসে বোস!' জীবনে প্রথমবার ফোঁটা নিয়ে খোকার তখন সে যে কী আনন্দ! ঠাকুমা সবাইকে নিয়ে যেন সেই আনন্দের ঝরণাতলায় সিক্ত হলেন, পূর্ণ হলেন।

ঠাকুমা যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রতিবার নিয়ম করে ঘি ঢেলেছেন, খোকাকে ফোঁটা দিয়েছেন ভাইফোঁটায়। ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর বউদিদের হাতে, বিয়ের পর শ্যালিকাদের হাতেও ফোঁটা নিয়েছেন খোকা, অর্থাৎ সেজদাদু। তাঁর ভেতরের সেই কবেকার ছেলেমানুষটা কখনই হারিয়ে যায়নি। তাই যখন আমার দিদির জন্ম হল, সেকালের নিয়ম অনুযায়ী মেয়ে জন্মানোর জন্য সবার চোখে যখন জল এলো, তখন একমাত্র সেজদাদুই আনন্দে নেচে উঠেছিলেন! বলেছিলেন, 'ওরে আমার বোন এসেছে, এবার আমি বোন পেয়েছি, তোরা চোখে জল নিয়েই থাক, তোরা কী করে বুঝবি আমার আনন্দ! তোরা তো বুঝিসই না সংসারে মেয়ে কত বড় ধন!'   

দিদি একটু বড় হতেই সেজদাদু তার হাতে ফোঁটা নিতে শুরু করেছিলেন। সেই ছোট্ট থেকে 'যমের দুয়ারে' কাঁটা দেওয়ার প্রার্থনা মাথায় নিতে নিতে বিরানব্বই বছর বেঁচেছিলেন মানুষটা। তাঁর বুকের ভেতর শেষদিন অব্দি বেঁচে ছিল সেই বছর পাঁচের শিশুটি, যে শিশুটির আজীবন পিপাসা ছিল ভাইফোঁটার ভেতরে আবহমানের লুকিয়ে থাকা ভাইবোনের মধুমাখা স্নেহটুকু আস্বাদের। চন্দনছোঁয়া আঙুলে সেই স্নেহ-ভালবাসার স্পর্শ তাঁকে যেন দিয়ে যেত বেঁচে থাকার নিশ্বাস, তাঁর মধ্য দিয়েই যেন আমাদের কাছে পূর্ণতা নিয়ে ধরা দিত 'ভাইফোঁটা'র মানে...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...