তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব তখন মুর্শিদকুলি খাঁ। মুর্শিদাবাদে জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। রাজপ্রাসাদে শীতের প্রয়োজনীয় সবকিছুই ছিল। লেপ, কম্বল, শাল। কিন্তু নবাব যেন কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না। লেপ,
কম্বল ব্যবহার করেও ঠান্ডাকে কাবু করা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, লেপ, কম্বলের ওজনেও ভারি বিরক্ত হচ্ছিলেন নবাব। সেই সময় শীতবস্ত্র হিসেবে শালের সমাদর ছিল। নবাবও শাল ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। কিন্তু একটা লেপ বা কম্বলের বদলে দুটো বা তিনটে ভারী শাল ব্যবহার করেও শীতকে কাবু করতে পারছিলেন না নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। রাজার শীত বলে কথা। সকলেই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
মুর্শিদকুলি খাঁর জামাই ছিলেন সুজাউদ্দিন, যিনি পরবর্তীকালে বাংলার নবাব হয়েছিলেন। উপায় বের করলেন সুজাউদ্দিন। অনেক ভাবনাচিন্তার পর সুজাউদ্দিন-এর নির্দেশে খলিফা রমজান শেখ তৈরি করলেন তুলোর হালকা আবরণ। কার্পাস তুলোকে ঢেকে দেওয়া হলো সুন্দর সিল্ক কাপড়ে। নাম দেওয়া হলো বালাপোষ।
নবাবী আমলে বালাপোষ তৈরীর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল উন্নত মানের কার্পাস তুলো। প্রথমে নানা উপায়ে তুলো নরম করা হল। তারপর সেই নরম তুলোকে রঙিন জলে ডুবিয়ে তার গায়ে রং দেওয়া হল। অবশেষে শুকিয়ে সিল্কের কাপড়ের মধ্যে এই তুলো ভরে দেওয়া হল। নবাবের জন্য বিশেষভাবে তৈরি হল বালাপোষ। এবার তার পরীক্ষার পালা।
নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ বালাপোষ ব্যবহার করে বুঝলেন হালকা, তুলোয় মোড়া এই কাঁথা শীতের নরম রোদের মতোই। ওজনে হালকা, এটা ব্যবহারে কাবু নাছোড় শীত। সেই সময় থেকেই প্রচলন হয় বালাপোষ ব্যবহারের।
কিন্তু শীত তো কয়েকমাসের অতিথি। তাই বছরের বেশিরভাগ সময়টাই বালাপোষের স্থান ছিল রাজপ্রাসাদের আলমারি। তাই অনেকটা সময় অব্যবহৃত থাকার ফলে বালাপোষগুলোতে কেমন যেন সোঁদা গন্ধ লেগে থাকত। এই গন্ধ আবার অপছন্দ ছিল নবাবের। তাহলে উপায়? আবার ভরসা সুজাউদ্দিন। উপায় বার করলেন তিনি। কার্পাস তুলো বালাপোষে ভরার আগেই তাতে মাখানো হলো আতর। ফলে কোনরকম গন্ধেরই আর অবকাশ রইল না। বেজায় খুশি হলেন নবাব। মুর্শিদাবাদের সর্বত্র তখন খলিফা রমজান শেখের তৈরি বালাপোষের সুখ্যাতি। রাজার শীতকে কাবু করতে পারা তো আর সহজ কথা ছিলো না।
মুর্শিদাবাদে এভাবেই প্রথম বালাপোষ তৈরি শুরু হয়। শীতের এই নরম কাঁথা খুব সহজেই তার ব্যবহারকারীদের মন জয় করেছিল। ফলে বাংলার কুটির শিল্প হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল বালাপোষ তৈরি।
যথেষ্ট দক্ষতার প্রয়োজন হয় একটা বালাপোষ তৈরি করতে। কাজটা বেশ সময়সাপেক্ষও। কার্পাস তুলোকে রঙ মাখিয়ে সেই রং শুকোলে তারপর তাতে আতর ভরা হত। তুলো শুকোতে শুকোতেই গড়িয়ে যেত বেশ কয়েক দিন। দক্ষ শ্রমিকেরা ভালোবেসেই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে লাগলেন।
ভালো বালাপোষ তৈরীর মূল মন্ত্র ছিল সেলাই। কাপড়ের উপর সেলাইয়ের কাজ চলত অত্যন্ত দক্ষ হাতে। চারপাশের মজবুত সেলাইয়ের জন্যই আটকে থাকতো তুলো। দু'ধরনের পাড় ব্যবহার করা হতো। একটি অংশ বরফি এবং অন্যটি লাহারিয়া নামে পরিচিত। সেই সময় মুর্শিদাবাদের বালাপোষের সুখ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া।
তারপর সময় এগিয়েছে। আধুনিক হয়েছে শীত এবং শীতের সময়ে ব্যবহৃত সমস্ত জিনিসপত্র। বালাপোষের চল এখন আর সেভাবে নেই। সেই উন্নত মানের তুলো, দক্ষ শিল্পীদেরও দেখা মেলে না। তবে সরকারের উদ্যোগে কিছু কিছু জায়গায় এখনো টিকে রয়েছে এই কুটির শিল্প। সম্প্রতি কাটোয়ায় একটি বালাপোষ তৈরীর হাবও তৈরি হয়েছে। তবে ওই পর্যন্তই। আগেকার মতো আর ব্যবহৃত হয় না বালাপোষ। শুধু কিছু কিছু আলমারিতে ভাঁজে ভাঁজে শীতের সোঁদা গন্ধ আর স্মৃতি নিয়ে এখনো রয়েছে বালাপোষ।