হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত এই যে আমাদের শহর, আমাদের প্রিয় শহর, আমাদের প্রাণের শহর কলকাতা - এই শহরের আনাচে কানাচে লেখা রয়েছে কত জানা অজানা ইতিহাস। যেমন এই হুগলি নদী, যাকে আমরা গঙ্গা নদীই বলি - কলকাতায় তার ঘাটগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত পুরনো দিনের কথা, কত জানা অজানা মানুষের স্মৃতি।
আজকের আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে আছে "বাগবাজার গঙ্গার ঘাট"। বাগবাজার বললেই মনে আসে শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব, শ্রীশ্রী সারদা মা, মায়েরবাড়ি, বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরি, গিরিশ চন্দ্র ঘোষের বাড়ি, স্বামী বিবেকানন্দ ও উদ্বোধন পত্রিকার অফিস এবং এই কলকাতার প্রথম বারোয়ারি দুর্গোৎসব, বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গাপূজা এবং তার সাথে বাগবাজার গঙ্গার ঘাট।
এই বাগবাজার ঘাট তৈরি করেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার উপ-প্রধানমন্ত্রী রাজা রায়দুর্লভ রায়ের পুত্র রাজা রাজবল্লভ রায়। রায়দুর্লভ সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও তাঁর পুত্র রাজবল্লভ সমাজের উন্নতির জন্য অনেক কাজ করেছিলেন। তিনিই নাকি জনসাধারণের হিতার্থে এই ঘাট বানিয়ে দিয়েছিলেন। যিনিই বানিয়ে থাকুন তিনি যে জনসাধারণের হিতাকাঙ্খী ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
টেকচাঁদ ঠাকুর (বাংলা সাহিত্যে প্রথম উপন্যাস রচয়িতা প্যারীচাঁদ মিত্র) তাঁর "আলালের ঘরের দুলাল" - এ (বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস, ১৮৫৮) বাগবাজার ঘাটের প্রতিদিনের কাজকর্মের একটি ভারি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। একটুখানি তুলে দিই সেখান থেকে....
"নৌকা দেখিতে দেখিতে ভাঁটার জোরে বাগবাজারের ঘাটে আসিয়া ভিড়িল। রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে - কলুর ঘানি জুড়ে দিয়েছে, বল্দেরা গোরু লইয়া চলিয়াছে – ধোপার গাধা থপাস থপাস করিয়া যাইতেছে – মাছের ও তরকারির বাজরা হু হু করিয়া আসিতেছে - ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন – মেয়েরা ঘাটে সারি সারি হইয়া পরস্পর মনের কথাবার্ত্তা কহিতেছে। কেহ বলিতেছে, পাপ ঠাকুরঝির জ্বালায় প্রাণটা গেল – কেহ বলে, আমার শাশুড়ি মাগী বড় বৌকাঁটকি – কেহ বলে, দিদি, আমার আর বাঁচতে সাধ নাই - বৌছুঁড়ী আমাকে দুপা দিয়া থেতলায় – বেটা কিছুই বলে না, ছোঁড়াটাকে গুণ ক’রে ভেড়া বানিয়েছে কেহ বলে, আহা, এমন পোড়া জাও পেয়েছিলাম, দিবারাত্রি আমার বুকে ব’সে ভাত রাঁধে, কেহ বলে, আমার কোলের ছেলেটির বয়স দশ বৎসর হইল - কবে মরি কবে বাঁচি, এই বেলা তার বিয়েটি দিয়ে নিই।"
এই ঘাটে একসময় শ্রী শ্রী সারদা মায়ের পদধূলি পড়েছিল। প্রথম থেকে শুরু করে আজও এই ঘাটেই বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গা পূজার নবপত্রিকা স্নান করানো হয়। এই একশো বছরেরও পুরনো ঐতিহ্যময় বাগবাজার গঙ্গার ঘাট এখনো মানুষের প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।