'অম্বুবাচী' কী?
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর "বাঙ্গালা ভাষার অভিধান"-এ লিখছেন যে, 'জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তির পর যে সময় সূর্য মিথুন রাশিতে গমন করিয়া আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদ ভোগ করে সেই সময়কেই অম্বুবাচী বলে।" জ্ঞানেন্দ্রমোহন কথিত রাশিনামেই ওড়িশায় অম্বুবাচীকালে একটি উৎসব হয়, যার অন্যতম নাম, 'মিথুন সংক্রান্তি'। তবে, 'রজ' বা 'রজ উৎসব'-নামেই এই উৎসবটি আমাদের কাছে বেশি পরিচিত।
আসাম বা অন্যান্য প্রদেশে যেমন মেয়েরা যখনই প্রথম ঋতুমতী হয়, তখনই উৎসব হয়; ওড়িশায় তেমনটা হয় না। এখানে উৎসব হয় কেবলমাত্র বছরে একবার, শুধু 'অম্বুবাচী'র সময়।
কারণ, ওড়িশাবাসীরা মনে করেন যে, বিষ্ণু বা জগন্নাথের পত্নী ভূদেবী এই সময়ই প্রথম ঋতুমতী হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, এই ভূদেবী আর কেউ নন, আমাদের ধরিত্রীমায়েরই রূপান্তর।
চারদিনের এই উৎসবে ঋতুমতী ধরিত্রীমা এবং পরিবারের মেয়েদের এক করে বিশেষ সম্মান জানানো হয়। তাঁদের দৈনন্দিন কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং অঢেল আনন্দে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। একক নির্বাসনে পাঠিয়ে ঋতুমতী এবং তার ঋতুকালটিকে অশুচি বলে দেগে দেওয়া হয় না। বাড়ির সকলের সঙ্গে সে আনন্দে উৎসবটি উদযাপন করে।
তবে, ঋতুমতী ও সন্তানকামী বধূদের এই সময় সামান্য বিধিনিষেধ মানতে হয়। সেগুলো একে একে বলছি।
উৎসব শুরুর আগের দিনটি, উৎসব-প্রস্তুতির দিন। তার নাম, 'সাজবাজা'। এ-দিন আগামি তিনদিনের জন্য খাবার, নানান পিঠে (যেমন, 'পোড়াপিঠে') ইত্যাদি তৈরি করে ঘর-রান্নাঘর সব পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলা হয়।
পরের দিন উৎসব শুরু। এ-দিনটির নাম, 'পহিলি রজ'। বাড়ির মেয়েরা এ-দিন খুব ভোরে উঠে গায়ে হলুদ-তেল মেখে ভালো করে স্নান করে নেন। কারণ, পরবর্তী দু'দিন তাঁরা আর স্নান করতে পারবেন না, খালি পায়ে হাঁটতে পারবেন না, কোনকিছু কাঁটা-ছেঁড়া করতে বা রান্না করতেও পারবেন না।
পহিলি রজের দিন থেকে বাড়ির সকলেই ফল, পিঠে এবং বাসিখাবার খেতে শুরু করেন। মেয়েরা নতুন শাড়ি পরেন, পায়ে আলতা পরে গয়নাগাঁটি-ফুলের সাজে খুব করে সেজেগুজে থাকেন আর পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আনন্দে সময় কাটান।
গ্রামের মেয়ে-মহিলারা অবশ্য এই সময় বটগাছে দোলনা বেঁধে ইচ্ছেমতন দোল খেতে খেতে মনের সুখে লোকগানে মত্ত হন। এমনি করেই কেটে যায় দ্বিতীয় দিন, যার নাম, 'মিথুন সংক্রান্তি' বা 'রজ সংক্রান্তি'। কেটে যায় তৃতীয় দিনও। যার নাম, 'ভূদহ' বা 'ভূমি দহন' বা 'বাসি রজ'।
উৎসবের ক'দিন ধরিত্রীমাকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্যও কিছু বিধিনিষেধ থাকে। তা হল, তাঁকে কর্ষণ করে বা তাঁর বুকে আগুন জ্বেলে কষ্ট দেওয়া যাবে না। তাই এই সময় চাষবাস বা রান্না কিছুই করা যায় না।
চতুর্থ দিনটির নাম, 'বসুমতী স্নান'। এ-দিন ধরিত্রীমায়ের প্রতীক রান্নাঘরের শিল অর্থাৎ 'পিধি' বা 'পিধা'টিকে স্নান করানো হয়। ঋতুসমাপ্তিতে বাড়ির মেয়েরা যেভাবে এ-দিন স্নান করে শুদ্ধ হন, সেভাবেই। এরপর গোবর, দুব্বো ঘাস, সিঁদুর ও ফুল দিয়ে সাজিয়ে পুজো করা হয়।
তারপর রান্নাঘরের কাজে শিলের পুনর্ব্যবহার শুরু হয়। এ-দিন থেকে রান্নাবান্নাও শুরু হয়। মেয়েরা হেঁশেলে এসে ঢোকেন। কৃষকও ফেরেন চাষের কাজে। উৎসব শেষে এভাবেই নৈমিত্তিক কাজের ধারাটি শুরু হয়ে যায় ওড়িশায়।
কেরালায় মেয়েরা প্রথমবার ঋতুমতী হলেই যে অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হয়, তার নাম, 'থিরান্দুকল্যাণম' বা 'থিরুন্দুকুলি'। মালয়ালম ভাষায় 'কল্যাণম' মানে, 'বিবাহ'। অর্থাৎ, এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মেয়ে যে সন্তানধারণ ও বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে, এটাই স্পষ্ট করা হয়।
থিরান্দুকল্যাণম চারদিনের অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান এখন 'নায়ার' সম্প্রদায়ের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। এঁদের পরিবার মাতৃতান্ত্রিক। নারীরাই পরিবারে প্রধান। মেয়েদের মধ্যে দিয়ে বংশধারা প্রবাহিত হবে, এটাই তাঁদের বিশ্বাস। তাই পরিবারে মেয়ে প্রথম ঋতুমতী হলেই তাঁরা সেটা আনন্দ-উৎসবে পরিণত করেন।
বাড়ির মেয়ে ঋতুমতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবারের মহিলারা মুখ দিয়ে অদ্ভুত এক সুতীব্র কর্কশ আওয়াজ করেন। একে বলে, 'কুরাভা'। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা পাড়া-প্রতিবেশীকে জানান দেন যে, তাঁদের মেয়েটি ঋতুমতী হয়ে এইমাত্র নারীত্বে উপনীত হল।
পরিবার মাতৃতান্ত্রিক হলেও মেয়েদের ঋতুকালটিকে এখানে অপবিত্রতার কাল বলেই মনে করা হয়। তাই মেয়েটির ওপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
ঋতুমতী হওয়ার পর মেয়েটিকে নতুন কাপড় ও গয়না পরিয়ে একটি নির্জন ঘরে এনে বসানো হয়। তার সামনে চালের গুঁড়ো মাখানো তামার পাত্র, একটি উদুখল (শস্য ভাঙার প্রাচীন যন্ত্র) ও একটি ঝাঁটা রাখা হয়। পাত্রে দেওয়া হয় নারকেল মঞ্জরী।
শুরু হয় 'অষ্টমঙ্গলা' অনুষ্ঠান। একজন নাপিতানী এসে মেয়েটির কানে বিড় বিড় করে মন্ত্র বলতে বলতে মাথায় আতপচালের ছিটে দেয়। আসলে, বিশ্বাস করা হয় যে, দেবী ভগবতী প্রথম ঋতুকালে মেয়েদের শরীরে এসে প্রবেশ করেন, আর এই মঙ্গল অনুষ্ঠান করলে তিনি শুভ ফল রেখে বিদায় নেন।
আগামি তিনদিন মেয়েটিকে এই ঘরে একা থাকতে হবে। বাড়ির এবং আত্মীয় মহিলা ছাড়া আর কেউ এই সময় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন না। কোন পুরুষের মুখ মেয়েটি এ-ক'দিন দেখতেও পাবে না। আলাদা পাত্রে খাবার খাবে। ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে থাকতে হবে। খাবারের মধ্যে কেবল ফল, গুড়, ভাত ও শাক-সবজি খেতে পারবে।
চতুর্থ দিন মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি কোন মন্দিরের সরোবরে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে বাড়ি ফেরে। তখন তাকে নতুন শাড়ি এবং গয়নায় মুড়ে একবারে কনের মতো করে সাজানো হয়।
এ-দিন সমস্ত পাড়া-প্রতিবেশীকে নিমন্ত্রণ করা হয়। তাঁরা মেয়েটিকে নানান উপহার দিয়ে এক জমজমাট ভোজসভায় অংশ নেন। এভাবেই দারুণ জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়। যদিও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই জাঁক আজ অনেকটাই কমে এসেছে।
অন্ধ্রপ্রদেশে মেয়েদের প্রথম ঋতুদর্শনকে কেন্দ্র করে যে উৎসবটি হয়, তার নাম, 'ঋতুশুদ্ধি' বা 'ঋতুকলা সংস্কারা'। শহরে এই উৎসবের নাম, 'হাফ শাড়ি ফাংশান'।
গ্রামের দিকে মেয়ে ঋতুমতী হলে নির্জন ঘরে বা আলাদা কুঁড়েতে মেয়েটির থাকার ব্যবস্থা করা হয়। মেয়েটি সেই ঘরে মামাবাড়ি থেকে দেওয়া চাটাই বিছিয়ে শোয়, বসে, ঘুমোয়।
প্রথম দিন সেই চাটাইতে শুয়ে মেয়েটি দেওয়ালের দিকে পিঠ ফিরে চাপ দিয়ে যতগুলো হলুদের বল দেওয়ালে সাঁটতে পারে, ততদিন তাকে বিধিনিষেধের মধ্যে এই ঘরেই থাকতে হয়। এই সময়টা সে গৃহস্থালির কোন জিনিস ছুঁতে পারে না, স্নান করতে পারে না এবং তাকে আলাদা পাত্রে খেতে দেওয়া হয়।
এই দিনগুলোতেই কোন একটা সময় এসে জ্যোতিষী তার ঋতুকালের শুভাশুভ নির্ণয় করে প্রতিকারের বিধান দিয়ে যায়।
মেয়েটির ঋতুধারা যেদিন সমাপ্ত হয়, সেদিন বাড়ির কোন বয়স্কা মহিলা তাকে হলুদ ও নিমপাতা গোলা জলে স্নান করিয়ে শুদ্ধ করেন।
তারপর শুরু হয় শেষ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানেই প্রথম মেয়েটি শাড়ি পরার অধিকার পায়। শাড়িটিও আসে মামারবাড়ি থেকে।
শাড়ি-গয়না-ফুলমালায় সুসজ্জিত হয়ে মেয়েটি একটি মণ্ডপে এসে বসলে তাকে নানাবিধ উপহার দিয়ে তবে নিমন্ত্রিত জ্ঞাতি-কুটুম্বরা ভুরিভোজে অংশ নেন। আর এসবের মধ্যে দিয়েই মেয়েটির নারীত্ব সামাজিকভাবে স্বীকৃত হয়।
অন্ধ্রপ্রদেশের ঋতু-উৎসবটিই ভিন্ন নামে দেখা যায় তামিলনাড়ুতে। সেখানে এই উৎসবের নাম, 'মঞ্জল নিরাথু ভিঝা'; যার অর্থ, হলুদজলে স্নাপন অনুষ্ঠান।
কর্ণাটকে 'টুলু' সম্প্রদায়ের মানুষ অম্বুবাচী উৎসবটিই ভিন্ন নামে পালন করেন মাঘ মাস নাগাদ। এঁরা এই সময়টিকেই মাটিমায়ের ঋতুকাল বলে মনে করেন। এঁদের 'অম্বুবাচী'র নাম, 'কেদ্দাসো'। এই উৎসবে এঁরা মাটিমা ও গৃহকন্যাকে বাঙালির মতোই এক করেন না।
উৎসবটি চারদিনের। তার মধ্যে তিনদিন কৃষিকাজ একেবারেই বন্ধ থাকে, মাটিতেও আঘাত করা যায় না। কৃষিভুমিকে এ-সময় তাঁরা পূর্ণ বিশ্রাম দেন।
উৎসবের দিনগুলোতে বাড়ির অভিজ্ঞ মহিলারা প্রতিদিন খুব সকালে উঠে তুলসীতলায় গোবরছড়া দিয়ে প্রদীপ জ্বালান। মঞ্চের গায়ে সিঁদুরের ফোঁটা এঁকে মাটিকে তেল ভোজন করানোর জন্য মাটিতে নারকেল তেল ঢালেন। মাঘের শীতে যাতে ধরিত্রীর শরীর গরম থাকে সেই জন্য। তারপর তাঁর উদ্দেশ্যে পায়েস উৎসর্গ করেন।
বাড়ির পুরুষেরা এই সময় অবশ্যই শিকারে যান। কৃষিকাজে হানি ঘটায় এমন পশুদের হত্যা করেন। মাটির উপর রক্তপাত ঘটান। এভাবেই তাঁদের সংস্কৃতিতে আদিম ঋতুভাবনার উদযাপন দেখা যায় এই 'কেদ্দাসো' নামের অনুষ্ঠান বা পার্বণের মধ্য দিয়ে।
এতদূর এসে দেখা যাচ্ছে যে, 'অম্বুবাচী' শুধু একটি স্থানিক পার্বণ নয়, সময়ের নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বাঁধাও নয়; বরং এমন এক প্রজনন প্রস্তুতির উৎসব, যা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন নামে আমাদের দেশের নানান প্রান্তে উদযাপিত হয়। আমাদের প্রবহমান সংস্কৃতির ক্ষীয়মাণ কয়েকটি ধারাকে সঙ্গী করে ভালো-মন্দের স্রোত হয়ে উৎসবের মেজাজ নিয়ে আজও বয়ে চলেছে...
চারপর্বের তথ্যঋণ:
- "On the Construction of Gender: Hindu Girls in Patrilineal India", Economic and Political Weekly, Vol. 23, No. 18 (Apr. 30, 1988) by Leela Dubey.
- "Kali: The Feminine Force" by Ajit Mukherjee.
- A Celebration Of Womanhood And Periods: Raja Parba And Ambubachi Mela by Sahapedia.
- 'Thirandukalyanam In Kerala Is Seen As A ‘Progressive’ Celebration Of Menstruation, But Is It Really?' by Suaranya.
- 'Traditions Across Parts Of India Where First Period Is Celebrated' by Shraddha Goled.
- 'Celebrating the menstruating Goddess in a Kerala temple? Not completely' by Harita John.