দেবী শক্তির 'অম্বুবাচী' ও ঋতু-উৎসবের ঐতিহ্য: তৃতীয় পর্ব

আসামের কামাখ্যা এবং কেরলের ভগবতী-দুই দেবী ঋতুকালে অপবিত্র বিবেচিত হলেও তাঁদের ঋতুরঞ্জিত বস্ত্র ভক্তদের কাছে পবিত্র, সৌভাগ্যদায়ী, মঙ্গলকারী বলে গৃহীত হয়। কিন্তু, কেন?


এরকম প্রশ্নের মধ্য দিয়েই আমরা বিগত দুটি পর্ব শেষ করেছিলাম। এবার উত্তর দেওয়ার পালা। সেই সঙ্গে অবশ্য আরও অনেক ঋতু-রিচুয়াল ও ঋতু-উৎসবের খবর জানানোর কথা। তার আগে উত্তরটা দিয়ে নিই:


ধর্মের মোড়কে বা ধর্মাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যে-সব রীতি বহুকাল যাবৎ আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে চলে আসছে, তার উৎস খুঁজতে হলে লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে নৃতাত্ত্বিক খননের প্রয়োজন হয়। তাতেও অবশ্য প্রকৃত উৎস পাওয়া যায় না সবসময়, অনেক সময়েই উৎসের আভাসমাত্র পাওয়া যায়। এক্ষেত্রেও তাই।


উৎস বিচার করতে গেলে দেখা যায় যে, আমাদের অধিকাংশ পূজা-পার্বণ-উৎসবের মূলেই আছে কিন্তু, 'কৃষি'। আসলে, আদিম যুগে আমরা প্রথমে ছিলাম উঞ্ছজীবী, তারপর হলাম  শিকারজীবী, তার পরে হয়েছি কৃষিজীবী। 


কৃষিকাজ করতে গিয়ে আমরা একসময় মাটিকে নারীর সঙ্গে এক করেছি। কারণ, দুজনেই জননী-জন্মদাত্রী। 


আমরা যখন দেখেছি যে, নারীর জন্মযন্ত্র বেয়ে রক্তপ্রবাহ নিষ্পন্ন হওয়ার পর পরই নারী গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠেন; তখন আমরা এই রক্তপ্রবাহকে অত্যন্ত পবিত্র, শুভকর, মঙ্গলকর বলে মনে করেছি। আর কল্পনা করেছি, মাটিরও যদি এমন রক্তপ্রবাহ হত, তাহলে তা আরও বেশি বেশি করে শস্য-সন্তানের জন্ম দিতে পারত।


এই ভাবনা থেকেই নারীর ঋতুধারা নকল করে আমরা শিকারকৃত পশুর রক্ত কৃষিভূমিতে ছড়িয়েছি। তাতে অধিক ফসল পেয়ে ধন্যও হয়েছি। আর বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, ধরিত্রী এভাবে ঋতুমতী হলেন বলেই আমরা শস্যবান হলাম।

Ambubachi5

তারপর সমাজ এবং ধর্ম যখন আমাদের ঘাড়ে চেপে বসল, তখন নানান বিধিনিষেধ ও অনুশাসন তৈরি হল। এক শ্রেণির মানুষকে হীন দেখিয়ে, আর-এক শ্রেণির মানুষকে বড় করা হল। পুরুষকে বড় করার জন্য নারীকে হীন করা হল। তখন নারীর ঋতু এবং তাঁর ঋতুকালকেও হীনচোখে দেখানো শুরু হল। আমরা দেখলাম। তাঁকে ঋতুকালে নির্জন-নির্বাসে পাঠাতে লাগলাম।


তারপর একদিন মাটি হয়ে উঠলেন আমাদের কাছে, 'ভূদেবী'। দেবদেবীরা হয়ে উঠলেন আমাদের সর্বেসর্বা। তারপরেও ধর্ম এঁদের ঋতুকাল ঠিক করল, পূজ্য করেও এ-সময়টায় অচ্ছুৎ ঘোষণা করল। নারীদের বুঝিয়ে দিল, দেবীদের যদি এ-হাল করতে পারি, তোমরা তো কোন ছার! 


আমরা ধর্মের পায়ে মাথা রেখে ঋতুমতী নারীকে হীন ভাবলাম, তাঁর ঋতুধারাকে অপবিত্র মানলাম, ঋতুমতী দেবীকেও অশুদ্ধা জানলাম; কিন্তু, দেবীর ঋতুধারাকে অশুচি ভাবতে পারলাম না। 


কেননা, মাটি 'ভূদেবী' এবং ভূদেবী 'দেবী শক্তি'র রূপান্তর হয়ে উঠেছেন ততদিনে। ততদিনে আমাদের লোভেরও রূপান্তর ঘটেছে। ঋতুধারাযুক্ত মাটি থেকে প্রচুর শস্য পাওয়ার সুপ্রাচীন লোভ পর্যবসিত হয়েছে দেবীর ঋতুরঞ্জিত বস্ত্র অধিকার করে সংসারের সমৃদ্ধি ঘটিয়ে নেওয়ায়। মনে হয়েছে, ওই রক্তে যদি মাটি শ্রীময়ী হয়, তাহলে সংসার সমৃদ্ধ হবে না কেন! ও যে পবিত্র, মঙ্গলকর, শুভকর!


এ-কারণেই কামাখ্যা বা কেরলের শক্তিপীঠে দেবীর ঋতুরঞ্জিত বস্ত্র অধিকার করতে ভক্তেরা এতটা তৎপর হন, আজও... 


আর আমাদের এই ভক্তিকে হাতিয়ার করেই দেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঐতিহ্যকে সত্যি বলে প্রমাণ করতে কামাখ্যার যোনি-কুণ্ড থেকে উদ্ভুত রেড-অক্সাইড মিশ্রিত লাল জলকে দেবীর 'ঋতু' বলেই ঘোষণা করা হয়; আবার জল যথেষ্ট লাল না-হলে সেবায়েত কর্তৃক সিঁদুর মেশানোর কথাও শোনা গেছে। 


আর, কেরলের মন্দিরে আসলে কী হয়, (কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটানো হয়) তা শবরীমালা মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের স্ত্রী, ভগবতী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বা তাঁর পরিবারের মেয়েরা ছাড়া অন্য কেউ জানেন না। তবে আমরা শুধু জানি, যে-দেবী শারীরিকভাবে ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়াশীল নন, তাঁর শরীরবৃত্তীয় ধারাপাত হতেই পারে না।


যাই হোক, ধর্মীয় নানান অভিঘাত পেরনো আমাদের তথাকথিত উন্নত সমাজ ঋতুমতী নারীকে হীন ভাবতে যেমন শিখেছে, তেমনি এ-সমাজে নারীরাও ক্রমশ নিজেকে হীন ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছেন।


তাই, ঋতুদর্শনের প্রসঙ্গ এবং তা নিয়ে আলোচনা ক্রমশ সংসারে ও লোকসমাজে লজ্জার বিষয় হয়ে উঠেছে। উত্তর ও পশ্চিম ভারত অবশ্য এ-পথে চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। 

Ambubachi6

কিন্তু, পূর্ব, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের আসাম, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও কেরালা অন্তত 'গোপনীয়' সংস্কৃতির ইতিহাসে পথ ভেঙেছে। সেখানকার সম্প্রদায় বিশেষের মানুষেরা মেয়েদের প্রথম ঋতুদর্শনের চমৎকার ঘটনাটিকে প্রাচীনকালেই আনুষ্ঠানিক উৎসবে পরিণত করে ফেলেছেন।


আসামে এই ঋতু-উৎসব বা অনুষ্ঠানটির নাম, 'তুলনী বিয়া'; অর্থাৎ, বিবাহের দিকে এগনো। প্রথম ঋতুদর্শনের মধ্য দিয়ে একটি মেয়ে নারীত্বের পথে পা দিল এবং সে যে বিবাহ ও সন্তানধারণের জন্য উপযুক্ত হল--এটাই সমাজের কাছে ঘোষণা করা এই উৎসবের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।


অনুষ্ঠানের আচার-পালন চলে সাত দিন ধরে। এই সাত দিন ঋতুমতী মেয়েটি কাউকে স্পর্শ করতে পারে না, তাকেও কেউ না। কারণ, সে অপবিত্র। নির্জন ঘরে তাকে একাকী তিন দিন থাকতে হয়, শুতে হয় মেঝেতে খড়ের বিছানায়। 


এই তিন দিন সে রাঁধা খাবার খেতে পায় না। ফল, ভেজানো ছোলা, কড়াই এবং কাঁচা দুধ খেয়েই তাকে দিন কাটাতে হয়। তাছাড়া, এই সময় সে স্নান, চুল আঁচড়ানো, নখ কাটা, এমনকি কোন পুরুষের দিকে তাকাতে অব্দি পারে না। তাকে পাহারা দেবার জন্য পূর্বেই 'তুলনী বিয়া' হয়েছে, এমন ক'জন তারই বয়সী সদ্য-নারী থাকে ঘরের বাইরে।


বাড়িতে পুরুত আসেন প্রথম দিনই। তাঁর কাজ হল, মেয়েটির ঋতুদর্শনের কাল নিরূপণ করে শুভাশুভ এবং ভবিষ্যৎ-বিবাহে মেয়েটি সুখী হবে কি না নির্ণয় করা। খুব ভোরে ঋতুপাত শুরু হয়ে থাকলে মেয়েটি স্বভাবে 'পদ্মিনী', সকালে হয়ে থাকলে 'শিপ্রানী' বা চঞ্চলা, দুপুরে হয়ে থাকলে 'উগ্রা', আর সন্ধেয় হয়ে থাকলে, 'হস্তিনী'। এ-সবের ওপর ভিত্তি করে শুরু হয় গণনা। গণনায় খারাপ কিছু থাকলে দক্ষিণার বিনিময়ে প্রতিকারের বিধান দিয়ে পুরুত বিদায় নেন।


চতুর্থ দিনে মেয়েটি নিজেই স্নান করে। বিয়ের সময় লোকে যেমন মাখে, তেমনি করে হলুদ মেখে। তার স্নানের জায়গায় একটি কলাগাছ থাকে। এটিই এই উৎসবে তার প্রতীকী বর। 


বাড়ির সমস্ত মেয়ে ও মহিলারা স্নানের পর তাকে মঙ্গলাশীর্বাদ করে। তারপর সে ভিজে কাপড় ছেড়ে ঐতিহ্যবাহী পোশাক 'মেখলা-চাদর' পরে। পোশাক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসে। এ-দিন থেকে সে রাঁধা খাবার ভোজনের অনুমতি পায়। তবে, মাটির পাত্রে রাঁধতে হবে তাকেই।


সপ্তম দিনে মেয়েটি আবার স্নান করার সুযোগ পায়। শুদ্ধি-স্নান। এ-দিন বাড়ি-পড়শির মেয়ে-মহিলারা সবাই মিলে তাকে স্নান করায়। এবং অবশ্যই সেই কলাগাছটির সামনে। 


স্নান করিয়ে মেয়েটিকে সবাই মিলে একেবারে বিয়ের কনেটির মতো করে সাজায়। এভাবে সেজেগুজে সে একটি কক্ষে গিয়ে বসে। বাড়িতে যেসব নিমন্ত্রিত বন্ধুবান্ধব-পাড়া-প্রতিবেশী-অতিথি-অভ্যাগরা আসেন, তাঁরা সেখানে গিয়ে মেয়েটিকে যথেচ্ছ উপহার দেন ও আশীর্বাদ করেন।


বাইরে সুস্বাদু আহারের ঢালাও ব্যবস্থা থাকে। অবশেষে সকলে মিলে তুমুল হৈহল্লার মধ্য দিয়ে ভোজনতৃপ্ত হয়ে উৎসবটি উদযাপন করেন।

বিবরণে আমরা দেখতে পেলাম যে, 'তুলনী বিয়া'র আচারের মধ্যে সেই চিরাচরিত অস্পৃশ্যতার অসুখ থাকলেও 'ঋতুদর্শন'-কে কেউ কিন্তু খারাপ চোখে দেখেন না। দেখলে, উদযাপনটি এমন উৎসবের রূপ পেত না। উৎসবের এই রূপটি অবশ্য এখন সহজলভ্য নয়, পরিবর্তিত মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গে এরও ক্রমশ বিলোপ ঘটছে।


আসামের ঋতু-উৎসব শেষ হল ঠিকই, এবার কিন্তু অন্যান্য প্রদেশের ঋতু-উৎসবের কথাও বলব। আর নির্ণয় করব, তাদের সঙ্গে 'অম্বুবাচী'র যোগ। তবে, আগামি পর্বে। আজ এ-পর্যন্তই...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...