দেবী শক্তির 'অম্বুবাচী' ও ঋতু-উৎসবের ঐতিহ্য: দ্বিতীয় পর্ব

আজ যে দেবীর ঋতুকালের কথা বলব, তাঁর মন্দিরটি কেরালার আলাপ্পুঝা জেলার চেঙ্গান্নুরের পম্বা নদীর ধারে অবস্থিত। শৈবদের কাছে মন্দিরটির নাম, 'মহাদেব ক্ষেত্রম'। আর, শাক্তদের কাছে, 'পার্বতী মন্দির'।


নামকরণের এমন দ্বৈধতার কারণ, মন্দিরের গর্ভগৃহে পুবমুখী শিলার শিবলিঙ্গ যেমন রয়েছেন; লিঙ্গের পেছনেই তেমনি পশ্চিমমুখী হয়ে রয়েছেন দেবী পার্বতী। পার্বতীর মূর্তিটি পঞ্চধাতুর তৈরি। সেটি প্রয়োজনে সরানো যায়।


শিব ও শক্তির এই পীঠটি কেরালার সবচেয়ে প্রাচীনতম পীঠ। মন্দিরটিও তাই। খ্রিস্টীয় ৩০০ অব্দে এটি তৈরি হয়েছিল। মূল মন্দিরটি মূলত কাঠের তৈরি। 

কিংবদন্তি থেকে জানা যায় যে, কেরালার সেই সময়কার শ্রেষ্ঠ দারুশিল্পী পেরুন্থাচান মন্দিরটির পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তৈরি করেছিলেন। তবে, ঐতিহাসিক তথ্য থেকে যা জানা যায়, তা হল, আজ থেকে দুশো বছর আগে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুরনো মন্দিরের একটি বড় অংশ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তারপর অবশ্য তাঞ্জাভুরের শ্রেষ্ঠ দারুশিল্পীদের দিয়ে সেই নষ্ঠ অংশসমূহ পুনর্নির্মাণ করানো হয়।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, পম্বা নদীর তীরে শক্তিপীঠটি গড়ে উঠল কীভাবে?


গড়ে ওঠার কোন ঐতিহাসিক বিবরণ তো নেই-ই, এমনকি পৌরাণিক কাহিনি পর্যন্ত নেই। আছে শুধুই কিংবদন্তি।


সেই কিংবদন্তি যাঁদের মুখে মুখে একদিন গড়ে উঠেছিল, পৃথিবীর বিস্তার সম্পর্কে তাঁদের কোন ধারণাই ছিল না। পৃথিবী যে প্রায় গোলাকার একটি গ্রহ--এটা তাঁরা একেবারেই জানতেন না। তাঁদের ধারণা ছিল যে, উত্তরের হিমালয় পর্বতে পৃথিবী শুরু হয়ে শেষ হয়েছে দক্ষিণে কেরলের সমুদ্রে এসে। একটা এবড়ো-খেবড়ো ধাতবপাতের মতোই সেটা ভেসে আছে ওই সমুদ্রেরই জলে!

Ambubachi3

তবে, পৌরাণিক কাহিনি তাঁদের কিছু কিছু জানা ছিল। সেটার জোরে এবং বিশ্ব সম্পর্কে অদ্ভুত ধারণার সম্মিলনেই তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন এই শক্তিপীঠের ইতিহাস। সেই কপোলকল্পিত ইতিহাসই লোকের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে আজ যুগান্তর পেরিয়ে হয়ে উঠেছে কিংবদন্তি।


কিংবদন্তির সেই গল্পটিই এবার একেবারে ছোট্ট করে বলছি। শুনুন:


শিব-পার্বতীর বিবাহ হচ্ছে হিমালয় পর্বতে বেশ ধুমধাম করে। যথারীতি বিয়েতে স্বর্গলোকের সমস্ত দেবদেবী নিমন্ত্রিত। এবং, তাঁরা সকলেই নিমন্ত্রণরক্ষার জন্য একেবারে অদম্য উৎসাহে তৈরি। কিন্তু, হিমালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে তাঁরা একটা কথা ভেবে খুব সমস্যায় পড়ে গেলেন। কী সমস্যা?


সমস্যাটা হল, সমস্ত দেবলোক যদি হিমালয়ে হাজির হয়, তাহলে পৃথিবীর একদিক তো অসম্ভব ভারি হয়ে যাবে। তখন ভারি দিকটা টাল সামলাতে না-পেরে নীচে নেমে যাবে এবং বিপরীত দিকটা উপরের দিকে উঠে আসবে! এমনটা হলে, পৃথিবীর জীবকুলের ভয়ানক বিপদ হবে, সকলেই উত্তরের দিকে গড়াতে গড়াতে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে! তাহলে এখন উপায়?


ভাবতে ভাবতে দেবলোকে একসময় উপায় হিসেবে উঠে এল অগস্ত্যমুনির নাম। তিনি এমন শক্তিধর যে, সমুদ্রের ওপর রাগ করে একবার এক নিঃশ্বাসে তার সমস্ত জল পান করে ফেলেছিলেন! এক্ষেত্রেও তিনি যদি দক্ষিণের কেরলে গিয়ে দেবলোকের সমস্ত দেবতাদের দেহভারের সমতুল্য ভার আপন শরীরে তৈরি করে অবস্থান করেন তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। শুধু তাঁকে সেখানে এভাবে থাকতে হবে শিব-পার্বতীর বিবাহ শেষ হওয়া অব্দি, ব্যস। 


যেমন ভাবা তেমন কাজ। দেবতারা তক্ষুনি অগস্ত্যমুনির কাছে গিয়ে সহায়তা করতে অনুরোধ করলেন। তিনি তো বেজায় ভালোমানুষ, তাই সমস্যাটি বুঝে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। এবং, কেরালার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।


দেবদেবীরা তখন ভারি নিশ্চিন্ত হয়ে শিব-পার্বতীর বিয়েতে গিয়ে যোগ দিলেন। স্বভাবিকভাবেই সদলে তাঁদের দেখে শিব-পার্বতী দুজনেই যার পর নাই আনন্দিত হলেন। কিন্তু, তারই মাঝে তাঁরা খেয়াল করলেন যে, বিবাহে আর-সকলেই উপস্থিত থাকলেও অগস্ত্যমুনি নেই! কেন? দেবতাদের কাছে খোঁজ নিতেই অবশ্য জানতে পারলেন আসল বিষয়টা। এবং, জেনে বেশ খুশিই হলেন তাঁরা।


তারপর নির্বিঘ্নে বিবাহ সমাধা হতেই শিব-পার্বতী দুজনেই অত্যন্ত উতলা হলেন অগস্ত্যমুনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। কারণ, যিনি নিজে অনুপস্থিত থেকে আর-সকলের উপস্থিতিতে বিবাহ-অনুষ্ঠান মনোরম হয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সম্মান জানানোটা একান্ত কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। ফলে, তক্ষুনি নববরবধূ রওনা দিলেন সোজা কেরলের পথে।


শিব-পার্বতী যখন অগস্ত্যমুনির কাছে পৌঁছলেন, তখন মুনিবর দেহভার বাড়িয়ে পম্বা নদীর তীরে বসে। কিন্তু, তিন জনে মুখোমুখি হওয়ার আগেই পার্বতীর হঠাৎ ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেল। তিনি শিবের কাছ থেকে দূরে সরে পার্শ্ববর্তী নির্জন বিতানে চারদিন একাকী বাস করার পর স্নান করে মুনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। কৃতজ্ঞতা জানালেন। সম্মানিত হয়ে মুনিও কৃতার্থ হলেন।

Ambubachi4

তারপর অগস্ত্যমুনির সঙ্গে এই বিশেষ সাক্ষাৎটিকে স্মরণীয় করে রাখতে শিব-পার্বতী মূর্তিরূপে সাক্ষাৎস্থলে বিরাজমান হয়ে থাকতে মনস্থ করলেন। এবং, সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিরূপে প্রকট হলেন। তারপর কালক্রমে স্থানীয় অধিবাসীরা তাঁদের পুজো করতে করতে একদিন স্থায়ী মন্দির তৈরি করল এবং স্থানটি ধীরে ধীরে বিশিষ্ট 'পীঠ' হিসেবে আপামর ভক্তদের কাছে বিখ্যাত হয়ে উঠল।


শোনা যায়, শুরু থেকে বেশ কয়েক বছর আগে পর্যন্তও নাকি দেবীর মাসে মাসে ঋতুস্রাব হত। এখন হয় শুধু দু'তিন মাস বা মাস চারেক পর পর। এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটানোর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ থাকতে পারে। কারণ, ঋতুস্রাবের সময় তিন দিন মন্দির পুরো বন্ধ থাকে। এই ক'দিন ভক্তসমাগমও হয় না। ফলে, দক্ষিণা-প্রণামীর সমাগমও বন্ধ থাকে। এই সমাগমটিকে নিয়মিত রাখতেই হয়তো দেবীর ঋতুকালটিকে অনিয়মিত করে ফেলা হয়েছে।


সময়-অসময় নির্বিশেষে দেবীর ঋতুস্রাব শুরু হয়েছে কি না, এটা সকালে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার একমাত্র দায়িত্ব হল মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের। এই সময় তিনি একা দেবীর কাছে যাবেন, সঙ্গে কেউ থাকবেন না। তিনি যদি দেবীর পরনের কাপড়ে রক্তভেজা দাগ দেখতে পান, তখনই শবরীমালা মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের পত্নীকে ডাকা হয়। তিনি এসে রক্তের দাগ পরীক্ষা করে যদি মনে করেন যে, দেবী ঋতুমতী হয়েছেন, তখন তিনি তা ঘোষণা করে যান।


ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই দেবীমূর্তিকে শিবের নিকট থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। রাখা হয় একা একটি ঘরে, দরজা বন্ধ করে। সেই ঘরের বাইরে অর্থাৎ বারান্দামতো জায়গায় মন্দির-পুরোহিতের বাড়ির কয়েকজন মহিলা দিনরাত পাহারায় থাকেন। আর প্রতিদিন সকালে দেবীর ঋতুরঞ্জিত কাপড় সরিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দেন। এটাই তাঁদের কাজ।


চার দিনের দিন দেবীকে নির্জনবাস থেকে বের করে পম্বা নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর স্নান করিয়ে শুদ্ধ করে মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয় এবং মহাদেবের নিকটে দেবীকে পুনরায় স্থাপন করা হয়। 


এ-দিন থেকে আবার ভক্ত সমাগম শুরু হয়। ধুমধাম করে দিনে পাঁচ বার পুজোর যে রীতি, সেই রীতিরও যথারীতি পালন শুরু হয়।


দেবীর ঋতুস্নানের পরের ব্যাপারটিতে কামাখ্যার শক্তিপীঠের সঙ্গে কেরলের শক্তিপীঠের দারুণ মিল। সেটি হচ্ছে, ভক্তদের ভাবনা। দেবীকে ঋতুকালে অশুদ্ধা করে রেখেও তাঁর ঋতুরঞ্জিত কাপড়টিকে অতীব শুদ্ধ, সৌভাগ্যদায়ী এবং মঙ্গলকারী মনে করেন কামাখ্যার মতো এখানকার ভক্তরাও। তিন দিনের জমানো আসল কাপড় বা তার টুকরো-টাকরা ভক্তদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এখানেও বেশ চড়াদামে বিক্রি হয়।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঋতুরঞ্জিত কাপড়টি পাবার জন্য ভক্তদের এই যে এত আকাঙ্ক্ষা, এই যে কাপড়টিকে শুদ্ধ-সৌভাগ্যদায়ী-মঙ্গলকারী ভাবা হচ্ছে, এই ভাবনার উৎসটা কী? তাতে 'অম্বুবাচী'র যোগ কোথায়?



উত্তর এবং এ-সম্পর্কিত আরও নতুন নতুন গল্প নিয়ে আসব আগামি পর্বে। আজ এই পর্যন্তই...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...