'অম্বুবাচী' আসলে, উর্বরতার অপেক্ষা। দেবীরূপে নারী, মাটিরূপে মা-দুইয়েরই জন্য জেগে থাকে এই 'অপেক্ষা'। আমরা জানি, 'অম্বুবাচী' হল দেবী শক্তি এবং ধরিত্রীমায়ের ঋতুদর্শন বা ঋতুকালীন উৎসব।
সাধারণ দৃষ্টিতে এবং প্রথাগত ধারণায় নারীকে ঋতুকালে যেভাবে কোথাও কোথাও এখনও অস্পৃশ্য ভাবা হয়, সংসারের কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, শতখানেক বছর আগেও তাকে এই সময় যেভাবে আলাদা ঘরে নির্বাসনে রাখা হত, ঋতুধারা সমাপ্ত হলে নির্বাসনমুক্ত হয়ে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে নৈমিত্তিক সংসারের কাজে পুনরায় বহাল হতে হত; এই ঋতুকালে সেবায়েতদের কাছে, ভক্তদের কাছে তেমনই বৈষম্যমূলক ব্যবহার পান দেবী শক্তি, আর কৃষকের কাছে পান মা ধরিত্রী। এই বৈষম্যকেই আড়াল করা হয় 'উৎসব' বা 'পার্বণ' নাম দিয়ে।
'অম্বুবাচী'র এই বিধিনিষেধ শুরু হয় 'প্রবৃত্তি'-তে; শেষ হয় 'নিবৃত্তি'-তে। চলে চার দিন ধরে। ঋতুস্নানের পর নারী যেমন সন্তানধারণের জন্য প্রস্তুত হন, তেমনি দেবী প্রস্তুত হন নতুন সৃষ্টির জন্য, ধরিত্রী প্রস্তুত হন নতুন ফসলের জন্ম দিতে। তাই বলছিলাম যে, 'অম্বুবাচী' হল আসলে, উর্বরতার অপেক্ষা। কারণ, দেবী ও ধরিত্রী দুজনেই অনন্ত যৌবনা, জনন-সক্ষমা।
অম্বুবাচীর এই চারটি দিনের মধ্যে তিন দিন দেশের সমস্ত শক্তিপীঠ সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। চতুর্থতম দিনে দেবীকে স্নান করানোর পর মন্দির খোলা হয়। এবার, কোন্ কোন্ শক্তিপীঠে কীভাবে এই 'অম্বুবাচী' পালিত হয়, আসুন তারই বিস্তারে প্রবেশ করি :
একান্ন শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম হল, কামাখ্যাপীঠ। মন্ত্রসাধনা-তন্ত্রসাধনা-দেবীমাহাত্ম্য সম্বন্ধে অসংখ্য কিংবদন্তি, অজস্র গালগল্প, অদ্ভুত রহস্যময় গূঢ়-রহস্যের ইঙ্গিতে বহুকাল ধরে কামাখ্যাপীঠ যেভাবে ভক্ত-সাধারণের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে; তেমনটা বা ততটা বোধহয় অন্য শক্তিপীঠগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় না। তাই এই শক্তিপীঠ, 'বিশেষ'।
বিশিষ্ট হয়ে ওঠার উপরোক্ত কারণগুলো ছাড়াও, রয়েছে এর আকর্ষণীয় উদ্ভবের উপাখ্যান।
কিংবদন্তি থেকে জানা যায় যে, সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে শিব যখন প্রলয়নাচন নাচছিলেন, তখন তাঁকে শান্ত করার জন্য সতীকে শিবের কাঁধ থেকে বিযুক্ত করার প্রয়োজন পড়ল। বিষ্ণু সেই কাজের ভার নিয়ে সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ক্রমাগত খণ্ডবিখণ্ড করতে লাগলেন। তাতে খণ্ড হল, একান্নটি। আর সেই খণ্ডগুলোই যেখানে যেখানে পড়ল, সেখানে সেখানে গড়ে উঠল এক একটি সতীপীঠ। ধীরে ধীরে সেগুলো পরিগণিত হতে শুরু করল জাগ্রত শক্তিপীঠ হিসেবে।
বর্তমান আসামের ব্রহ্মপুত্রতীরে যে নীলাচল পাহাড়ের উপর কামাখ্যা মন্দির অবস্থিত, সেখানে দেবী সতীর যোনি পতিত হয়েছিল। যোনি পতিত হয়ে পরিণত হয়েছিল শিলায়। গড়ে উঠেছিল তীর্থ। সেই তীর্থ উদ্ধার করে দেবীর প্রথম মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন পৌরাণিক অসুররাজ নরকাসুর। তারপর সেই মন্দির রাজরাজড়ার যুদ্ধে বেশ কয়েকবার ভেঙেছে, অনেকবার তৈরি হয়েছে।
কিংবদন্তি বাদ দিলে, ঐতিহাসিকভাবে জানা যাচ্ছে যে, বর্তমান মন্দিরটি তৈরি হয়েছে খ্রিস্টীয় ১৫৬৫ সালে। তৈরি করেছেন অহম রাজ্যের কোচ রাজা নরনারায়ণ। 'অম্বুবাচী' উপলক্ষে কামাখ্যায় বিখ্যাত যে 'অম্বুবাচী মেলা'টি বসে তারও ঐতিহাসিক উল্লেখ এই সময় থেকেই মেলে। সুতরাং, মেলাটির প্রামাণ্য বয়স পাঁচশো বছরের বেশি।
আমরা জানি যে, দেবী কামাখ্যার পীঠ-মন্দিরে মূর্তিতে পূজিত হন না। পূজিত হন, পাথরের যোনি-প্রতীকে। একটি প্রাকৃতিক ঝরণার জল সেই যোনি-কুণ্ডকে ঢেকে রাখে। গর্ভগৃহে প্রবেশ করে সেই কুণ্ডের জলের মধ্যে হাত দিলে নীচ থেকে জলস্রোত উঠে আসাটা যেমন টের পাওয়া যায়, তেমনি দেবীর যোনি-প্রতীকটিও অনুভব করা যায়।
এই দেবী বছরে একবারই ঋতুমতী হন। 'অম্বুবাচী'র সময়। অন্য সময় ঝর্ণার জলের রঙ স্বাভাবিক থাকলেও, অম্বুবাচীর সময় লাল হয়ে প্রবাহিত হয়। একেই দেবীর ঋতুস্রাব বলে মনে করা হয়।
দেবীর ঋতুস্রাব প্রসঙ্গে গবেষক অজিত মুখার্জি তাঁর "Kali: The Feminine Force" গ্রন্থে লিখেছেন, “During Ambubachi (July-August), after the first burst of the monsoon, a great ceremony takes place, for the water runs red with iron-oxide, and the ritual drink is symbolic of the rajas or ritu of the Devi, her menstrual blood.”
ঋতু-চলাকালীন তিন দিন দেবীর মন্দির বন্ধ থাকে। এই তিন দিন মন্দিরে পুজো হয় না, শাস্ত্রপাঠ হয় না, দেবীদর্শনও করা যায় না। দেবী এই মুহূর্তগুলোতে একা। গর্ভগৃহে একাকী আবদ্ধা। কেননা, তিনি এই সময় অশুদ্ধা!
ঋতুকালের চারটে দিন মন্দিরে সমাগম না-থাকলেও, মন্দিরের বাইরে জোরদার মেলা বসে যায়। (করোনা পরিস্থিতির জন্য গত বছর মেলা বসেনি, এ-বছরও বসবে না)। এতে দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার ভক্তের আগমন হয়। তাঁদের অপেক্ষা থাকে ঋতুস্নানের পর দেবীদর্শনের। পুজো দিয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার।
আরও একটা আগ্রহ তাঁদের থাকে, সেটা হল, নানারকম তান্ত্রিকদের সাক্ষাৎ পাবার। সাধকদের সিদ্ধাই বা ভোজবাজি দেখার। অনেক তান্ত্রিক-সাধক সারা বছর অন্তরালেই থাকেন, মেলার এই চারটি দিনের জন্য তাঁরা শুধু লোকসমক্ষে বেরিয়ে আসেন।
যাই হোক, অম্বুবাচীর চতুর্থতম দিনে গর্ভগৃহ থেকে প্রবাহিত ঝর্ণার লাল জল যখন স্বাভাবিক হয়; তখন মন্দির খোলা হয়। দেবীকে স্নান করিয়ে শুদ্ধ করে তারপর পুজো করা হয়। এর পর আপামর ভক্তদের জন্য মন্দির খুলে দেওয়া হয়। সকলকে প্রসাদ দেওয়া হয়।
প্রসাদের সঙ্গে সঙ্গে আর-একটি জিনিস পাবার জন্যও ভক্তরা এ-সময় লালায়িত হন। সেটি হচ্ছে, লাল কাপড়। দেবীর ঋতুরঞ্জিত কাপড়। কাপড়টি মঙ্গলকারী ও সৌভাগ্যদায়ী বলে ভক্তকুলের বিশ্বাস। তাই সকলেই তার অন্তত ছোট্ট একটি টুকরো পাবার জন্যও মরিয়া হয়ে ওঠেন। অর্থের বিনিময়ে শেষমেশ অবশ্য পেয়েও যান।
ভাবতে অবাক লাগে, যে ভক্তদের কাছে ঋতু অপবিত্র, ঋতুমতী দেবী অপবিত্র, সেই অপবিত্র দেবীকে যাঁরা ওই অপবিত্রকালে পুজো করলেন না, এমনকি দেবীর মুখও দেখলেন না; সেই তাঁদের কাছেই দেবীর ঋতুরঞ্জিত কাপড় মোটেই অপবিত্র হল না, হয়ে উঠল মঙ্গলময় ও সৌভাগ্যের আকর--কী অদ্ভুত স্ববিরোধীতা, তাই না?
নাকি, এর অন্য একটা দৃষ্টিকোণ আছে-যা আমাদের চোখে পড়ছে না?
প্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা হবে এবং সেই প্রসঙ্গে আর-এক শক্তিপীঠের 'অম্বুবাচী' পালনের ঐতিহ্য-কথা শোনাব আপনাদের। তবে, তা আগামি পর্বে। আজ এই পর্যন্তই...