এই অঞ্চলকে বলা হত ‘শেফিল্ড অফ দ্য ইস্ট’।
বিখ্যাত লেখক দোমিনিক লা পিয়ের এখানেরই কোনও এঁদো গলির অন্ধকারে থাকা শ্রমিক জীবন আর চোখে দেখা বিপন্নতা নিয়ে গড়ে ছিলেন বিখ্যাত উপন্যাস সিটি অফ জয়ের শরীর।
হাওড়া। কলকাতার সহোদরা শহর। গঙ্গার অন্য পাড়েই রাজধানী। কিন্তু সেই চাকচিক্য আর চর্চা থেকে দূরে গলি ঘুঁজির অন্দরে হাওড়ার নিজস্ব জীবন। ভিন্ন ছন্দে বয়ে যায়।
চিরুনির মত অলি-গলি-বাঁক। লাল ইঁট আর হলুদ আলোয় ঢাকা। চিমনির মাথা ছুঁয়ে যায় আকাশে। গঙ্গার গায়ে গা লাগিয়ে গল্প বলে চলে ইতিহাস। কলের গল্প। ঘামের গল্প। রক্তের গল্প। প্রেমে- প্রতিবাদে গাঁ শহর তখন একাকার। বিকেলের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে লোহা চুরের গন্ধে। সাইরেন বেজে ওঠ দূর থেকে। দিন ফুরিয়ে আসে। পরের দিনের ভোঁ- কান পেতে কারা যেন সব ঘরে ফিরে চলে।
এখন ছবি আলাদা। অথচ একদিন গঙ্গার এই তীরও কলের বাঁশির ডাকে কলকল করে উঠত।
হাওড়ার বুক জুড়ে চলত ন্যারো গেজের মার্টিন রেল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নয়, মার্টিন এন্ড কোং এর মালিকানাধীন। হাওড়া ময়দান থেকে আমতা অব্দি ছুটত ছোট রেল। সেই রেলে চেপে গাঁ দেশের মানুষ আসত ‘কলকাতা’র কারখানায় কাজ করতে।
উনিশ শতকে সদর হাওড়া জুড়ে শিল্পের যে ঢেউ দেখা গিয়েছিল সময়ের প্রভাবে তা এখন অনেকটাই ম্লান। তবে শহর যেমন ভাঙে তেমন শহর গড়েও ওঠে। ভাঙচুরের মধ্যে দিয়েই সময়ের এগিয়ে যাওয়া। সেরকম ভাঙচুরের ছন্দে বেঁচে আছে হাওড়া। শরীর জুড়ে তার দিন বদলের রং স্পষ্ট।
হাওড়া জেলার ইতিহাস প্রায় ৯০০ বছরের পুরনো। এক সময় ভুরসুট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতালির পর্যটক সিজার ফেদারিকির বইতে ‘ভুটর’ নামে একটি অঞ্চলের উল্লেখ করেন। এই ভূখন্ড হাওড়া বলে মনে করা হয়। তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায় ভুটর অঞ্চলে জাহাজ চলত। ব্যবসা বানিজ্যের কেন্দ্র ছিল। বেশ কিছু পুরাণ- পুঁথিতেও হাওড়ার বিভিন্ন জনপদের উল্লেখ মেলে। ভুটুরকে হাওড়ার জনপদ ‘ব্যাতড়’ বলে মনে করা হয়।
১৭৬০ সালে হাওড়া বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর হাওড়া ব্রিটিশের অধীনে আসে। ১৯৩৮ এর ১ জানুয়ারি হাওড়া স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা পায়। সেই অর্থে ১ জানুয়ারি হাওড়া জেলার জন্মদিন।
হাওড়া বদলাতে শুরু করল রেল টার্মিনাস তৈরি হবার পর। শিল্পনগরী হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেল। একদিকে রেল, জল, সড়ক তিন মাধ্যমে যোগাযোগের সুবিধা। অন্যদিকে হাতের কাছেই রাজধানী কলকাতা। সবটাই বানিজ্যের অনুকূল। হুগলী নদীর তীরে শিল্প গড়ে উঠতে লাগল।
কলকারখানা বিশেষ করে লৌহ-ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটতে লাগল দ্রুত। বদলে যেতে লাগল জীবন যাত্রা। কসমোপলিটন ছোঁয়া লাগল তার গায়ে। রেল গ্রামকে জুড়ল শহরের সঙ্গে। গ্রাম থেকে প্রচুর মানুষ কলকারখানায় নিযুক্ত হল। বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়।
১৮১৭ সালে বাউড়িয়াতে কটন মিল স্থাপিত হয়। এই কটন মিল ভারতের প্রথম কার্পাস বয়ন কারখানা। ১৮৩০ সালে জেসপ কোম্পানি হাওড়ায় তেলকল চালু করলে আরও অয়েল মিলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঘুসুড়ির ফোর্ট গ্লস্টারে জেলার প্রথম জুটমিল। এছাড়াও বড়-মাঝারি আরও প্রায় ২০ টি জুটমিল আছে সারা হাওড়া জুড়ে।
পরে বার্ন স্ট্যান্ডার্ড, জেংকিং এর মত সংস্থা আসে।
১৯০৫-এ হাওড়া স্টেশন আর ১৯৪৩-এ হাওড়া প্লটন ব্রিজ হাওড়ার শিল্প মানচিত্রে রাতারাতি আমূল পরিবর্তন এনে দিল।
জেলার প্রধান প্রধান শিল্পকেন্দ্রগুলি হল শিবপুর, বাউড়িয়া, অনন্তপুর, উলুবেড়িয়া, বালি, লিলুয়া, বেলুড়, আলমপুর, সাঁতরাগাছি, রামরাজাতলা, কদমতলা, সালকিয়া, দাশনগর, টিকিয়াপাড়া, বেলিলিয়াস রোড ও গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোডের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।হাওড়ার জাহাজ তৈরি ও মেরামত শিল্প ভারতে বৃহত্তম। জেলায় এই জাতীয় মোট চোদ্দোটি কারখানা রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সালকিয়ার হুগলি ডকিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, শিবপুরের শালিমার ওয়ার্কস, বটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে নাজিরগঞ্জের পোর্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস।
ইঞ্জিনিয়ারিং আর ফাউন্ড্রি শিল্পের ব্যাপক বিকাশের কারনে হাওড়া শিল্পাঞ্চলকে পূর্ব ভারতের শেফিল্ড বলা হত।
তাঁত ও পোশাক শিল্প হাওড়ার অন্যতম অর্থনৈতিক ভিত্তি। শাড়ি, চাদর, মশারি তৈরি হয়। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে হাওড়া, হুগলী ও মেদিনীপুরের তাঁত শিল্পীদের অনুরোধে আন্দুলের মল্লিক পরিবার চড়কডাঙায় ‘মঙ্গলা হাট’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি মঙ্গলবার হাট বসে বলে হাটের নাম ‘মঙ্গলাহাট’। লোকমুখে ‘মংলা’। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত হাট চলে। তাঁতের শাড়ি, ধুতি, গামছা এসবই মূল পণ্য।