রাজেন্দ্র দেব লেনের গন্ধেশ্বরী মন্দির

প্রসিদ্ধ বণিক সম্প্রদায় গন্ধবণিকদের আরাধ্যা তথা কূলদেবী দেবী হলেন গন্ধেশ্বরী। আদপে তিনি দেবী দুর্গারই রূপ। প্রসাধনী জিনিসপত্র, ধূপ, চন্দন কাঠ, সিঁদুর, নানারকম মশলা, ওষুধ, বারুদ ইত্যাদির বিকিকিনি করে এই বণিক সম্প্রদায়। গন্ধবণিকদের বিশ্বাস, দেবীর কৃপাতেই তাঁদের ব্যবসায়ের উন্নতি ঘটে, গন্ধেশ্বরীই তাঁদের ব্যবসাকে রক্ষা করেন। খাস কলকাতায় রয়েছে গন্ধেশ্বরী দেবীর মন্দির রয়েছে। ওই মন্দিরে নিত্যপুজো পান দেবী গন্ধেশ্বরী। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন গন্ধেশ্বরী মাতার বিশেষ পুজো হয়। বৌদ্ধ ধার্মালম্বীরাও গন্ধেশ্বরী দেবীর পুজো করেন। ওপার বাংলার পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে, অন্যান্য হিন্দু দেব দেবীর সঙ্গে গন্ধেশ্বরীরও একটি মূর্তি আছে। 

বিধানসরণীতে  ঠনঠনিয়া কালী মন্দিরের কাছেই মন্দিরটি অবস্থিত। ২১সি রাজেন্দ্র দেব লেনে মন্দিরটি অবস্থিত। পশ্চিমমুখী এই মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে দেবী গন্ধেশ্বরীর অষ্টধাতুর মূর্তি। মূর্তির উচ্চতা প্রায় তিনফুট। দেবী চতুর্ভুজা, তিনি ত্রিশূল হাতে গন্ধাসুরকে বধ করছেন। দেবী সিংহের ওপর দন্ডায়মান। তার নীচে রয়েছে গন্ধাসুর। গন্ধেশ্বরীর ধ্যান মন্ত্রে বলা হয়- দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নঃ, অর্থাৎ হে দেবী, আপনি আমাদের নিকট দুর্গতিহারিণী দুর্গাস্বরূপা হোন। দুর্গতিহারিণী দুর্গা রূপে আমাদের দুঃখ বিনাশ করুন। দুর্গা ও গন্ধেশ্বরী উভয়েই সিংহ বাহিনী এবং অসুরমর্দিনী। আবার কারও কারও মতে, গন্ধেশ্বরীর রূপ অনেকটা জগদ্ধাত্রীর রূপের মতই। এঁর হাতেও শঙ্খ, চক্র, ধনুর্বান শোভা পায়। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের ১৭ বৈশাখ গন্ধবণিক মহাসভার সেই সময়ের সভাপতি নৃত্যগোপাল রুদ্র উত্তর কলকাতার গন্ধেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, সুভূতি  ও তপতীর সন্তান ছিল গন্ধাসুর। সুভূতি একবার বৈশ্যকন্যা সুরূপাকে হরণ করে বিবাহ করতে চাইলে বৈশ্যদেরদের কাছে অপমানিত হন। পিতার অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গন্ধাসুর তৈরি হতে থাকে। সমস্ত বৈশ্যকুলকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করতে থাকে সে। মহাদেবের বরে বলিয়ান গন্ধাসুর। সে পরাক্রমশালী ও ত্রিভুবনজয়ী হিসেবে বর  লাভ করেছিল। গন্ধাসুরের অনুচররা সুবর্ণবট নামে এক বৈশ্য হত্যা করে। সেই সময় ওই বণিকের পত্নী চন্দ্রাবতী ছিলেন সন্তান সম্ভাবা। এক অরণ্যের মধ্যে একটি কন্যা সন্তানকে জন্ম দিয়েই চন্দ্রাবতী মৃত্যুবরণ করেন। দেবজ্ঞ মহর্ষি কশ্যপ আগে থেকেই জানতেন চন্দ্রাবতীর গর্ভে রয়েছে এক ঐশ্বরিক শিশু। তিনি ওই শিশুটিকে নিজের আশ্রমে নিয়ে আসেন এবং তার নামকরণ করেন গন্ধবতী‌। শিশুটির গা থেকে খুব সুন্দর একটি গন্ধ বের হত। 

মা-বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে রাক্ষসকূলের বিনাশের জন্য গন্ধবতী মহামায়ার তপস্যা শুরু করেন। গন্ধবতীর রূপ যৌবনের কথা  জেনে গন্ধাসুর তার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সেনাবাহিনী নিয়ে মহর্ষির আশ্রম আক্রমণ করে। সেখানে সে তপস্যারত গন্ধবতীকে নানাভাবে ভয় দেখাতে থাকে এবং উৎপাত করতে থাকে‌। কিন্তু গন্ধবতী তপস্যায় অবিচল। শেষে গন্ধাসুর উত্তেজিত হয়ে ওই আত্মমগ্ন ধ্যানস্থ গন্ধবতীর কেশ আকর্ষণ করা মাত্রই; গন্ধাসুর দেখে যজ্ঞের আগুন থেকে চতুর্ভুজা‌ সিংহবাহিনী দেবী আবির্ভূত হয়ে গন্ধাবতীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধের পর দেবী তাকে পরাস্ত করেন। এই দেবীই হলেন গন্ধেশ্বরী। মৃত্যুর পর গন্ধাসুরের দেহ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয় এবং সেখান থেকে একটি দ্বীপ জন্মায় যেখানে অজস্র গন্ধদ্রব্যের বৃক্ষ জন্মায়। এই দ্বীপটির নাম গন্ধদ্বীপ। প্রতিবছর বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের মানুষেরা নিজ গৃহে তাদের কূলদেবী দেবী গন্ধেশ্বরীর আরাধনা করেন।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...