কুড়মুন গ্রাম, মুছে যাওয়া গাজনোৎসব, খেস্যা গান আর নরমুণ্ড নিয়ে ‘শ্মশান-জাগানো’

এককালে রাঢ় বাংলার অন্যতম প্রধান উৎসব ছিল গাজন। কারো মতে, গর্জন থেকেই গাজন শব্দের উৎপত্তি। ভিন্ন মতে, ‘গাঁ’ অর্থে গ্রাম এবং ‘জন’ অর্থে জনগণ, অর্থাৎ গ্রামের জনগণের উৎসব। সাধারণত গ্রামবাংলায় সারাবছরের বিভিন্ন সময়ে বিশেষ বিশেষ সংক্রান্তি-উৎসবে লোককথা, ধর্মকথা, পৌরাণিক আখ্যান উচ্চমাত্রায় নাটকীয় ভঙ্গিতে গানের মাধ্যমে পরিবেশনই  গাজন, যা এক সময় ছিল বঙ্গ-সংস্কৃতির অঙ্গ, একুশ শতকে যার অস্তিত্ব প্রায় মুছে গিয়েছে বলাই চলে। ইতিহাস আমাদের অন্যতম পথপদর্শক, তাকে অবহেলা করে ভবিষ্যতের সঠিক মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভব। তাই সেই প্রায় মুছে যাওয়া অস্তিত্বের টুকরো স্মৃতি, বঙ্গ-সংস্কৃতির বিলুপ্ত বিষয় আর এক পল্লীগ্রামের কথা নিয়েই এই প্রবন্ধ।

বর্ধমান শহর থেকে প্রায় মেইল দশ উত্তর-পূর্বে কুড়মুন গ্রাম। তাঁর পাশেই রয়েছে পলাশী গ্রাম। একাধিক পলাশী নামের জন্য কুড়মুন ‘কুড়মুন-পলাশী’ বলে বিখ্যাত। রামমোহন রায় দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছিলেন এই কুড়মুন গ্রামেরই শ্রীমতী দেবী নামে এক ব্রাহ্মণকন্যাকে। গ্রামের ঈশানেশ্বর পাড়ায় তাঁর শ্বশুরালয়। কুড়মুন ও পলাশী তখন ছিল একেবারেই গণ্ডগ্রাম।

গ্রামের পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আভাস পাওয়া যেত। কুড়মুনের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে খড়েগশ্বর নদী। নদীর প্রবাহ বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে সরে এসেছে গ্রামের বসতিও। পুরনো সেইসব বসতির চিহ্ন আজ নদীগর্ভে। গ্রাম সম্বন্ধে প্রচলিত একটি ছড়ায় আজও কুড়মুনের এককালীন সমৃদ্ধির স্মৃতি খড়কুটোর মতো ভেসে আসে-

“বারো আহার, তেরো দীঘি, নুবড়ি গড়ে চ’বুড়ি ডোবা, তিনশো ষাট পুষ্করণী, এই নিয়ে কুড়মুন জানি।”

ইতিহাসের বয়ান অনুযায়ী কুড়মুনের বয়স প্রায় চার’শ। ঈশানেশ্বর শিবের গাজনতলায় মন্দিরের শিলালিপির তারিখ ১৬৬৭ শকাব্দ, ইংরেজি ১৭৪৫ সাল। গ্রামের প্রাচীন মুসলমান মুনশী পরিবারের তায়দাদের তারিখ বাংলা ১০৯৪ সন, ইংরেজী ১৬৮৭ সাল। কুড়মুনবাসী মোল্লা জাহেদ আলির মাতৃকুলের উর্ধতন পূর্বপুরুষকে বর্ধমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সঙ্গমরায়ের অধস্তন ষষ্ঠপুরুষ কৃষ্ণরাম রায় নিষ্কর সম্পত্তি দিয়েছিলেন, মখদুম সাহেবের আস্তানায় ‘চেরাগি ফকিরান খরচ সুরতে’, ১০৯৪ সনে (তায়দাদ নং ২৫৪১৩, বর্ধমান সদর)। তায়দাদ ও লিপি ছাড়াও অন্যান্য পরোক্ষ ইঙ্গিত অনুযায়ী কুড়মুনের প্রাচীনত্বের পরিচয় মেলে।

গ্রামের মধ্যে রয়েছে ‘ফকিরডাঙ্গা’ নামে একটি উঁচু ঢিবি। অনুমান করা হয় কোনও ইটপাথরের গৃহের ধ্বংসাবশেষ। গ্রামের লোকের বিশ্বাস, এখানে সাহজাহানের আমলের একটি মসজিদ ছিল। ভগ্নাবশেষ ও তাঁর অবস্থান দেখে মনে হয়, মসজিদটি দৈঘ্য-প্রস্থে বড়ই ছিল এবং ফকিরডাঙ্গায় একসময় পীর ফকিরদেরও বসতি ছিল। এখনও কুড়মুনের মুসলমানপাড়া এই এই ফকিরডাঙ্গার কাছেই। কুড়মুন একসময় মুসলমানপ্রধান সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল। মোগলযুগে কয়েকটি সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবার ও রাজকর্মচারী এই গ্রামে বসতি তৈরী করেন। অন্তত সপ্তদশ শতাব্দী থেকে মুসলমানরা কুড়মুন গ্রামের অন্যতম বাসিন্দা হয়েছিলেন মনে করা হয়।

গ্রামের উগ্রক্ষত্রিয় ও রাঢ়ীশ্রেণীর ব্রাহ্মণরা প্রাচীনদের মধ্যে অন্যতম। ‘মণ্ডল’ উপাধিধারী উগ্রক্ষত্রিয়রাই ঈশানেশ্বর শিবের বিখ্যাত গাজনের পরিচালক এবং ঘোষাল ব্রাহ্মণেরা পূজারী। মণ্ডলদের পূর্বপুরুষ সন্তোষ মণ্ডল(যিনি ঈশানেশ্বর শিবের উৎপত্তির কিংবদন্তীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত)। কিংবদন্তী হল, এই সন্তোষ মণ্ডলই স্বপ্ন দেখে খড়িনদীর কলমিসায়রের দহ থেকে ঈশানেশ্বর শিবকে নিয়ে এসে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন। সন্তোষ মণ্ডলের বংশধররাই বংশপরম্পরায় ঈশানেশ্বরের গাজন পরিচালনা করেন। সুতরাং কুড়মুন গ্রামের ঈশানেশ্বর শিবের বিখ্যাত গাজনোৎসব প্রায় আড়াইশ বছরের প্রাচীন উৎসব বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

হাড়ি, বান্দী ও ডোম প্রভৃতি জাতির বাস এককালে গ্রামে খুব বেশি ছিল। এখনও কুসম্যেটে, তেঁতুল ও দুলেদের বাস যথেষ্ট আছে গ্রামে। হাড়ী, বাগদী ও ডোমরা ছিল প্রধানত ধর্মঠাকুরের পূজারী। দুলেপাড়ায় এখনও এক ধর্মরাজ আছেন, তবে ঈশানেশ্বরের প্রভাবে তা ম্লান হয়ে যায়। এ ছাড়া, কুড়মুনের পূর্বপাড়ায় বুড়িগাছতলায় ‘কালাচাঁদ’ নামে আর এক ধর্মঠাকুর আছেন, সেবায়ত তন্তুবায়, ‘দেয়াসী’ বলা হয়। বৈশাখী বুদ্ধ পূর্ণিমায় হত উৎসব। ঈশানেশ্বরের গাজনের সময় সন্ন্যাসীরা বুড়িগাছতলায় কালাচাঁদের মন্দিরের সামনে জমায়েত হতেন। বর্ধমান-তথা রাঢ়দেশের আরও অন্যান্য অনেক গাজনের মতন, কুড়মুনের ঈশানেশ্বর শিবের গাজনও পূর্বের ধর্মের গাজনের রূপান্তর বলে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে।

শিবের অধিকাংশ ভক্ত্যা বা সন্ন্যাসীরা প্রধানত গোপ, বাগদী, দুলে, ডোম প্রভৃতি সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে শ্মশান-সন্যাসীরা। এছাড়া কালাচাঁদ ধর্মের মন্দিরে যে একাধিক কূর্মমূর্তি ধর্মঠাকুর দেখা যায়, তাঁর কারণ আগে গ্রামের মধ্যে একাধিক স্থানে ধর্মঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং ক্রমে তাঁর পুজো বন্ধ হওয়ার জন্য অথবা পূজারীবংশ লোপ পাবার জন্য মূর্তিগুলি একটি মন্দিরে এসে জমেছে। সকল ধর্মরাজের এক বিরাট সমবেত গাজনোৎসব হত মহাসমারোহে। তারপর গ্রামের প্রধানরা বোধ হয় একে শিবের গাজনে পরিণত করেন, সকল জাতির হিন্দুর সমাবেশের জন্য। গ্রামের মণ্ডলদের কথা সকলেই মেনে নেন। তারপর থেকে চৈত্র সংক্রান্তির ঈশানেশ্বরের গাজন হয়েছে প্রধান গাজন এবং কালাচাঁদ ধর্মের বৈশাখী উৎসব হয়েছে গৌণ।  ১৩ই চৈত্রের রাত্রি থেকে উৎসবাস্তু পর্যন্ত মণ্ডলদের তত্ত্বাবধানে শিব গাজনতলার মন্দিরে থাকেন এবং বাকি সময় থাকেন ব্রাহ্মণপাড়ার মন্দিরে। ব্রাহ্মণত্বের চাপে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে।

ঈশানেশ্বর শিব রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের মতন উচ্চবর্ণের কুলীন অভিজাত দেবতার পর্যবসিত হয়েছেন। কিন্তু শিব তো তা হতে পারেন না। তাঁর উপর অধিকার সকলেরই সমান থাকা উচিত, বিশেষ করে গাজনের সন্ন্যাসীদের। কিন্তু সন্ন্যাসীরা তো কুলীন ব্রাহ্মণ নন। অথচ তাঁরা শিবকে কাঁধে করে গ্রাম প্রদক্ষিণ করবেন, শিবকে স্পর্শ করবেন, মাথায় ফুল-বেলপাতা চাপাবেন। অতএব, স্বয়ং ঈশানেশ্বর শিব এক পুত্রের জন্ম দিলেন, তিনিও শিব, নাম ‘গাজনেশ্বর’। এই গাজনেশ্বরই জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সন্ন্যাসীদের স্কন্ধে চেপে গ্রাম-গ্রামান্তর প্রদক্ষিণ করেন, এবং সকলের দ্বারা পূজিত ও স্পর্শিত হন।

কুড়মুনের গাজন এ অঞ্চলের খুব বিখ্যাত গাজন। ২৫শে থেকে ২৮শে চৈত্র (মাস বাড়লে ২৬শে থেকে ২৯শে) চারদিন গ্রাম প্রদক্ষিণ করতেন শিব। গাজনেশ্বরই পালকি করে পাশাপাশি গ্রামে যান, সন্ন্যাসীরা পালকি বহন করতেন। মুখে রঙবেরঙের প্রলেপ লেপে, সেজেগুজে নাচতে নাচতে তাঁরা আসতেন গাজনতলায়। আগে যে মুখোস পরে নাচের প্রচলন ছিল তা বেশ বোঝা যায়। মুখোস করাও শক্ত, খরচসাপেক্ষও, তাই মুখে পেইন্ট করা হত।

ঐদিন কুড়মুনের পূব, পশ্চিম ও উত্তরপাড়া থেকে মাটির পুতুল-প্রতিমা নিয়ে এসে, গাজনতলায় তিনদিকের তিনটি বাঁশের গ্যালারীতে সাজানো হত। কুম্ভকার ও পটুয়ারা এই সব পুতুল তৈরী করতেন এবং সেগুলিকে বলা হত ‘ছবি’। সাধারণত পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে পুতুল তৈরী হত এবং পাড়ায় পাড়ায় তার প্রতিযোগীতা চলত। গাজনতলায় পুতুল সাজানো হলে, সকলে একমত হয়ে যে পাড়ার কল্যানৈপুণ্যের শ্রেষ্ঠতা ঘোষণা করে সেই পাড়ায় মৃৎশিল্পীদের কাঁধে তুলে নাচতেন। এই ছিল তাঁদের পুরস্কার। তাঁর আগে পাড়ায় ‘খেস্যা’ গান বলে একরকম গান হত। ঠিক কবিগান নয়, অথচ গানের টেকনিক অনেকটাই ছিল কবিগানের মতন। একপাড়ার গায়কেরা অন্য পাড়ায় একটা পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে গান গেয়ে আসতেন, তারপর আর একদিন সেই পাড়ায় লোক এসে এই পাড়ায় উত্তর দিয়ে যেতেন। সেই ‘খেস্যা’ গান আর নেই। পরদিন অর্থাৎ ২৯শে বা ৩০শে চৈত্র প্রত্যুষে শ্মশান-সন্ন্যাসীরা নরমুণ্ড নিয়ে উৎসব-নৃত্য করতেন। আসল নরমুণ্ড, নকল বা মাটির নয়। রাঢ়দেশের গাজনে আসল নরমুণ্ড নিয়ে উৎসবের প্রচলন ছিল। কুড়মুন গ্রাম এবং পাশের পলাশী গ্রামেও তাই রেওয়াজ ছিল।

শোনা যায়, পূর্বস্থলী থানায় মেঢ়তলার গাজনেও নরমুণ্ডের নৃত্যোৎসব হত। মুণ্ড-নৃত্য করার অধিকার সব সন্ন্যাসীর ছিল না, কেবল শ্মশান-সন্ন্যাসীদের থাকত। মণ্ডলরা অনুমতি দিলে শ্মশান-সন্ন্যাসীদের প্রধান যিনি, তিনি অধিকার মেনে নিতেন। সাধারণত, এই অধিকার দেখা যেত, বংশপরম্পরায়। শ্মশান-সন্ন্যাসীরা নরমুণ্ড গ্রাম্য শ্মশান থেকে সংগ্রহ করে পুতে রাখতেন মাটির তলায়। মধ্যে মধ্যে গিয়ে দেখে আসতেন বা পাহারা দিতেন। একে ‘শ্মশান-জাগানো’ বলা হত। হাতে তলোয়ার নিয়ে নৃত্য করে, নরমুণ্ডে তেল-সিঁদুর লেপে রাখা হত এবং উৎসবের দিন শেষ রাত্রে নিয়ে এসে গাজনতলায় নৃত্য করা হত। গ্রামে মড়ক মহামারী হলে সদ্যোমৃতের টাটকা মুণ্ড তলোয়ার দিয়ে কেটে এনে আগে সন্ন্যাসীরা নৃত্য করতেন বলে শোনা যায়। শিব শ্মশানে-মশানে থাকেন, ভূতপ্রেত তাঁর সহচর। শ্মশান–সন্ন্যাসীরা তাই শিবের সব চেয়ে নিকট-আত্মীয় এবং অন্যান্য শ্মশান-সন্ন্যাসীদের চেয়ে তাঁদের সম্মানও তাই বেশি। কুড়মুনের উগ্রক্ষত্রিয়, গোপ প্রভৃতিরা শৈবতান্ত্রিক ছিলেন। হাড়ি, বাগদী, দুলে, ডোম প্রভৃতি নিরঞ্জন ধর্মপন্থীদের উৎসবের সঙ্গে শৈবতান্ত্রিক উৎসবের মিলনমিশ্রণে ঈশানেশ্বর শিবের গাজন গড়ে উঠেছিল এবং আগাগোড়া গাজনের সব অনুষ্ঠান দেখলে এই কথাই মনে হত। 

কুড়মুনে এখনও বসে গাজন এর আসর, সময়ের বিবর্তনে যদিও তার ঐতিহ্য বিলীন হয়েছে। তবু ইতিহাস সেখানে এখনও টিম টিম করে জ্বলে থাকে।   

 

  

 

    

  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...