সতীপীঠঃ কন্যাকুমারিকায় আছেন মোক্ষদায়িনী আশ্রয়দাত্রী বিঘ্ননাশিনী ‘মা কন্যাকুমারী’

তামিলনাড়ুর পাদভূমির বেলা-অঞ্চলে যেখানে বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগর—এই ত্রয়ীর মিলন হয়েছে; সেখানে রয়েছে চারিদিকে লোনা জল ঘেরা ছোট্ট একটি দ্বীপ। সেই দ্বীপের নাম, ‘কন্যাকুমারিকা’। এই দ্বীপ দক্ষিণে ভারতের শেষ ভূখণ্ড। আমাদের দেশ ভারতবর্ষের চতুঃসীমা বর্ণনায় তাই এই স্থানের নাম বার বার আসে। এই স্থানের নাম ‘কন্যাকুমারিকা’ হয়েছে দেবী ‘কন্যাকুমারী’র নামে। পুরাণ ও তন্ত্রগ্রন্থগুলির মতে, এখানে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর মেরুদণ্ড পতিত হয়েছিল। দেবীর অঙ্গ ভূমিতে পতনের পর তা প্রস্তরীভূত হলে পতনের স্থান দেবীর পীঠস্থান হয়ে ওঠে। এবং এই পীঠস্থানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আদ্যাশক্তিকে ‘কন্যাকুমারী’-রূপে ভক্তজন উপাসনা শুরু করেন।

দেবীর নাম কেন ‘কন্যাকুমারী’ কেন হল, তা নিয়ে একখানা পৌরাণিক উপাখ্যান রয়েছে। সেটি হলঃ

বাণাসুর নামের এক অসুর একবার ভগবান শিবকে কঠোর তপস্যায় তুষ্ট করে একখানা বর লাভ করেছিল। তাতে সে একমাত্র কুমারী কন্যার হাতেই বধ্য ছিল; অন্য কেউ তার কেশাগ্র স্পর্শ করারও অধিকারী ছিল না। সে-কালে দশ বছর বয়সের মধ্যেই কন্যার বিবাহ হয়ে যেত; ফলে, এই বর লাভ করে বাণাসুর ভেবেই নিয়েছিল যে, সে অমর! কেননা, দশ বছরের কম বয়সী একটি মেয়ে তার বল-বিক্রম অতিক্রম করে তাকে হত্যা করবে কেমন করে!

যাই হোক, নিজেকে অমর বিবেচনা করে বাণাসুর দারুণ অত্যাচারী হয়ে উঠল। স্বর্গ থেকে মেরেধরে দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ অধিকার করে নিল। পাতাল তো তার অধীন ছিলই; মর্তে তার অত্যাচার এমন বাড়ল যে, ধর্মকর্ম চুলোয় গিয়ে ঘোর ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রব উঠল। তখন এই বেগতিক অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার জন্য দেব-মানব একত্র হয়ে ব্রহ্মার উপদেশে দেবী আদ্যাশক্তির আরাধনা শুরু করলেন। তাঁদের সম্মিলিত আরাধনায় দেবী তুষ্ট হয়ে বাণাসুরকে দমন করতে কুমারী কন্যা বা কন্যাকুমারী রূপে আবির্ভূতা হলেন। তিনি সকলকে বরাভয় দিয়ে আরও শক্তি সঞ্চয়ের জন্য তপস্যার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন সেই ছোট্ট নির্জন দ্বীপে, যেখানে পতিত হয়েছে দেবী সতীর মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ডে ষটচক্রের চারটি চক্র অবস্থিত; তাই এই ক্ষেত্র সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত। ফলত, দেবী এই পবিত্র ক্ষেত্রে এসে একটি বড় পাথরের ওপর কঠোর তপস্যায় বসলেন।

তপস্যায় বেশ কিছুকাল কাটল। এই অবস্থায় মহাদেব একদা ভ্রমণ করতে করতে এই স্থানে এসে দেবী কন্যাকুমারীর অপরূপ তপস্বিনী যোগিনীরূপ দেখে মোহিত হলেন। এবং দেবীকে সরাসরি বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। সেই প্রস্তাবে দেবী রাজিও হয়ে গেলেন। ঠিক হয়ে গেল বিবাহের দিন। ক্ষণ নির্দিষ্ট হল রাতের চতুর্থ প্রহর। সংবাদটি দেবমণ্ডলে প্রচারিত হতেই সবার একেবারে মাথায় হাত। দেবীর বিবাহ হলে দেবী তো আর কুমারী থাকবেন না, তাহলে বাণাসুরের দমন হবে কীভাবে! স্বয়ং যে-বিবাহ নির্দিষ্ট করেছেন, তা রদ করতে গেলে ত্রিজগতে আবার প্রলয় না নেমে আসে!

সবার যখন মাথায় হাত, তখন দেবর্ষি নারদ আসরে নামলেন বিবাহ রদের একটি গোছানো পরিকল্পনা নিয়ে। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ক্ষণের কিছু আগে যেই মহাদেব ভূত-প্রেত-গণ প্রভৃতি সমস্ত সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে মহা শোরগোল তুলে শোভাযাত্রা করে বিবাহের জন্য দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছেছেন; অমনি নারদ কুঁকড়োর রূপ ধরে ভোরের ডাক ডেকে উঠলেন। সেই ডাক যেই না মহাদেব শুনলেন অমনি বিবাহের শুভক্ষণ পার হয়ে গেছে ভেবে দারুণ হতাশ হয়ে সমস্ত কোলাহল থামিয়ে কৈলাসে ফিরে গেলেন।

এদিকে দেবী কন্যাকুমারী বিবাহসজ্জায় সেজে মহাদেবের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু রাত্রি অতিক্রম হয়ে গেলেও মহাদেব যখন এলেন না, তখন দেবীও হতাশ হয়ে সজ্জা খুলে আবার যোগিনীবেশে সেই বড় শিলায় গিয়ে তপস্যায় বসলেন। এই সময় সেখান দিয়ে বাণাসুর যেতে গিয়ে দেবীকে দেখে মুগ্ধ হল এবং আসুরিক বুদ্ধিতে জোর করে পেতে চাইল। এতে দেবী প্রচণ্ড রেগে গেলেন, ধরলেন রণরঙ্গিণী মূর্তি। শুরু হল যুদ্ধ, যুদ্ধ শেষে বাণাসুরকে বধ করে ত্রিলোকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে সকলের আরাধ্যা হলেন। অন্য মতে, দেবী বাণাসুরকে বধ করতে উদ্যত হলে দেবীর স্বরূপ বুঝতে পেরে বাণাসুর দেবীর চরণে আশ্রয় প্রার্থনা করে। তখন দেবী দয়া করে তাকে জীবন দান করে উদ্ধারের পথ বলে দেন। বলেন যে, এই তিন সাগরের সঙ্গমে স্নান করে দেবীর থানে পুজো দিলে শুধু বাণাসুর নয়, যুগে যুগে সমস্ত জীবের সারা জীবনের পাপ বিনষ্ট হবে, সকলে মুক্তির পথ খুঁজে পাবে।

সেই থেকে সকলের উদ্ধারের জন্য দেবী স্বয়ং সতীপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হয়ে বিরাজমান রইলেন। দেবী এই রূপে যেহেতু আর বিবাহ করলেন না, সেই হেতু দেবী সকলের কাছে ‘কন্যাকুমারী’ নামেই উপাসিতা হলেন। দেবীর নাম কন্যাকুমারী হলেও স্থানীয় ভক্তজনেরা তাঁকে ‘কুমারী আম্মা’ বা ‘ভগবতী আম্মা’ নামেও ডেকে থাকেন। তবে তন্ত্রগ্রন্থে সতীপীঠের অধিষ্ঠাত্রী এই দেবীকে ‘সর্বাণী’ ও তাঁর ভৈরব মহাদেবকে ‘নিমিষ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ভৈরবের মন্দির দেবীর মন্দিরপ্রাঙ্গণেই অবস্থিত।

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে এই দেবীতীর্থে এসে দেবীদর্শন ও পূজন করেন স্বয়ং স্বামী বিবেকান্দ। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপদেশ মাথায় নিয়ে তিনি এখানে দেবীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি দেবীর সান্নিধ্যে এসে তাঁকে উপলব্ধি করে ধন্য হন। এই মহান ঘটনা স্মরণে রাখতে, দেবী কন্যাকুমারী স্বয়ং যে বড় পাথরটিতে বসে সাধনা করতেন বলে কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে, সেই পাথরটির নাম ‘স্বামী বিবেকানন্দ রক’ রাখা হয়। পূর্বে এই পাথরটি ‘শ্রীপদপারাই’ নামদে পরিচিত ছিল। এই পাথরের ওপরে দেবীর পদচিহ্ন অঙ্কিত আছে। এবং তা পূজিত হয়।

দেবীপীঠের চারিদিকে শুধু জল আর জল, আর রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্য বিন্যাসের অপূর্ব সমারোহ। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য অসাধারণ সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয়। পূর্ণিমার অপরাহ্নে একদিকে সূর্যের অস্ত যাওয়া আর তারই সঙ্গে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হওয়ার অপরূপ মুহূর্তটির সাক্ষী থাকা যায় এখানে। চারিপাশে লোনা জল থাকলেও এখানকার ভূমিজ-জল কিন্তু সুমিষ্ট। এই জলকে ‘মূল গঙ্গা’র জল বলা হয়।

ভক্তজনের বিশ্বাস, দেবীর মন্দিরটি নাকি তিন হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন। কেননা, 'রামায়ণ', 'মহাভারত', 'যজুর্বেদ' প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থে রয়েছে দেবীর উল্লেখ। সেই ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই মন্দিরটি ভক্তজনের কাছে দেবী দুর্গার প্রকৃত ‘আলয়’ হিসেবে পুণ্যতীর্থ। সমগ্র ভারতবর্ষে স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম কর্তৃক স্থাপিত চারটি শক্তিমন্দিরের যে কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে; এটি নাকি তার একটি। তাই মন্দিরপ্রাঙ্গণের ছোট্ট প্রকোষ্ঠে পরশুরামের একটি নীল পাথরের মূর্তি রয়েছে, যা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হয়।

সহস্র বছর ধরে দেবীক্ষেত্রের অনেক পরিবর্তন হলেও দেবীর মন্দির একই রকম রয়ে রয়ে গেছে আজও। মন্দিরের চূড়া সুদৃশ্য লাল পাথরে তৈরি। মন্দিরের গাত্র নির্মিত হয়েছে রঙিন পাথরে। দ্বীপের ভূমি থেকে মন্দির অনেকটা উঁচুতে অবস্থিত। অনেকগুলো সুপ্রশস্ত সিঁড়ি অতিক্রম করে তবেই দেবীর দরবারে পৌঁছতে হয়।

মন্দিরের প্রবেশের মুখেই রয়েছে গণপতির অবস্থান। তাঁর মূর্তিকে প্রণতি জানিয়ে তাঁর আশীর্বাদ প্রথমে নিয়ে তারপর দেবীর কাছে যেতে হয়।  প্রশস্ত মণ্ডপ পেরিয়ে তবেই গর্ভগৃহে যাওয়া যায়।

গর্ভগৃহের রত্নবেদি অনুচ্চ। কালো পাথর ও রত্নের অভরণ দিয়ে তা মণ্ডপের আদলে নির্মিত। এই মণ্ডপের চৌদ্দদিতেই দেবীর অবস্থান। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দুটি হাত। দুই হাতে কোন অস্ত্র নেই। তাতে কেবলই বরাভয় আর ভক্তের জন্য অফুরন্ত আশ্রয়। দেবীর মাথায় প্রকাণ্ড রত্নমুকুট। দেবীর মুখমণ্ডল প্রশস্ত ও চিবুকের আকার কৌণিক। মুখে স্মিত প্রশ্রয়ের হাসি। তাঁর শান্ত দৃষ্টিতেও আশ্রয়। তাঁর সমগ্র মুখমণ্ডলে অদ্ভুত এক মমতাময় মাতৃত্বময় আকর্ষণ রয়েছে; তাই তাঁর সম্মুখে দাঁড়ালেই ভক্তজনের হৃদয় ঠেলে বেরিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত 'মা' ডাক। দেবীর অন্যতম আকর্ষণের বস্তু তাঁর মুখমণ্ডলের শোভা অসাধারণ সুন্দর হিরের নাকছাবি। কিংবদন্তি অনুসারে এই অলঙ্কার দেবীকে স্বয়ং নাগরাজ অর্ঘ্যরূপে দান করেছিলেন। এই নাকছাবির হিরের দ্যুতি অন্ধকারে অনেক দূর থেকেও ভক্তজন প্রত্যক্ষ করতে পারেন। দেবীর কন্ঠ ও বক্ষ অসংখ্য রত্নমালা এবং রত্ন আবরণে ঢাকা। কটি থেকে হাঁটু ছাড়িয়ে রয়েছে সিল্কের বর্ণিল বস্ত্র। তাঁর দুই পায়ের পাতাও নানান রত্নময় অলঙ্কারে ঢাকা।

মন্দিরের গর্ভগৃহে যেখানে দেবীর অবস্থান, সেখানকার চারটি স্তম্ভও সাধারণ ভক্তজনকে অসম্ভব আকৃষ্ট করে। কেননা, এই স্তম্ভগুলোতে আঘাত করলেই ভেতর থেকে বীণার ঝংকার শুনতে পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, এক-কালের স্থাপত্যবিদ্যার অপূর্ব নৈপুণ্যেই এই স্তম্ভগুলি নির্মিত, যা একালের কাছে বিস্ময়।

দেবীর মন্দির এখন তামিলনাড়ু রাজ্যের অধীন হলেও আগে কেরালার ত্রিবাঙ্কুরের  রাজার অধীনে ছিল।   তাই কেরালার শক্তি-আরাধনা যে তন্ত্রগ্রন্থের আধারে উদযাপিত হয়, সেই 'তন্ত্রসমুচ্চয়' গ্রন্থের নির্দেশ মেনেই দেবী কন্যাকুমারী'র উপাসনা করা হয়।

চৈত্র পূর্ণিমা, নবরাত্রি, বিজয় দশমী, বৈশাখ, কালাভাম প্রভৃতি উৎসব খুব ধুমধামের সঙ্গে এই মন্দিরে উদযাপিত হয়। এই সময় আলোয় আলোয় ফুলে ফুলে সেজে ওঠে সমস্ত পুণ্যভূমি। এই উপলক্ষে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্তজনের আগমনে স্নান-পূজনে এই ভূমি মহান মিলনভূমি হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে অনন্য মোক্ষতীর্থ।...    

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...