কালিকা বঙ্গদেশে চ, বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন দেবী কালী। কার্তিক অমাবস্যার অন্ধকারে কালভয়ভঞ্জিনী দেবী কালিকার পুজো হয়। সেই কালী নিয়েই আমাদের কালী কথা। কালী সাকার, সগুণ রূপেও নির্গুণ-ব্রহ্মস্বরূপ-প্রকাশিকা। নানা রূপে তিনি পূজিতা। কালী যেমন বিশ্বোত্তীর্ণা, তেমনি বিশ্বময়ীও বটে। একাধারে সৃষ্টি এবং প্রলয়ের অধিষ্ঠাত্রী কালী। এক হস্তে ভীতি-প্রদর্শন, অপর হস্তে অভয়দান। আজকের কালী কথায় বর্ধমানের কিছু কালী মন্দিরের কথা।
কালীগ্রাম আমাদপুর:
পূর্ব বর্ধমানের মেমারির আমাদপুর কালীগ্রাম নামেই পরিচিত। এই গ্রামে ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কালী পুজো হয়ে আসছে। এখানে কালীর চার বোন পূজিতা হন। তারা বড়মা, মেজমা, সেজমা, ছোটমা নামে খ্যাত। এই চার বোন ছাড়াও গোটা গ্রামে কমবেশি ১০০ যেমন পূজিতা হন। সিদ্ধেশ্বরী, বুড়িমা, ডাকাত কালী, ক্ষ্যাপা মা, আনন্দময়ী মা ইত্যাদি নানান নামে মা কালী এখানে পূজিতা হন।এখানে ভৈরবের পুজোও হয়।
আমাদপুর গ্রামের কালীপুজো নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। বর্ধমানের আমাদপুর গ্রাম এক প্রাচীন জনপদ। জনশ্রুতি রয়েছে, একদা এখানে বেহুলা নদী প্রবাহিত ছিল। এখন তা মজে গিয়ে খালের আকার নিয়েছে। শোনা যায়, নদীপথে বাণিজ্য চলত, তরী যাতায়াত করত। সেই সময়ে নাকি দস্যুদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাতে হত বণিকদের। সেই সময়ে আমাদপুরে বেহুলা নদীর ধারে ছিল মহাশ্মশান। সেখানে এক তান্ত্রিক থাকতেন। তিনি শ্মশানে কালীসাধনা করতেন। শোনা বণিকরা দস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে এই শ্মশানে কালী মায়ের পুজো দিতেন। শোনা যায়, এর পর থেকেই তাঁরা দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে শুরু করেন। তখন থেকেই এই দেবীর প্রতি বিশ্বাস জন্মায়। দেবীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পরে দিকে দিকে।
গ্রামে ২০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বড় মায়ের দর্শন পাওয়া যাবে। প্রায় সম উচ্চতার মেজ মারও দেখা মিলবে। কাছেই রয়েছে সেজ মা ও ছোট মার মন্দির। আর এই চার মা কালীকে ঘিরে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে পূজিত হন দেবী। মাকে তেরো রকম ভাজা নিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। শোল পোড়া, রুই মাছের তেল-ঝাল, মাছের টক, পায়েস ইত্যাদি দেওয়া হয়। কালী পুজো উপলক্ষ্যে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা কালী পুজোর দিনে এই গ্রামে এসে হাজির হন। বিসর্জনের সময়ে বড়, মেজ, সেজ আর ছোটমাকে চতুর্দোলায় করে শোভাযাত্রা বের হয়। সারা রাত গোটা গ্রাম ঘোরানোর পরে, ভোর বেলায় বিসর্জন হয়। এই চার দেবী ছাড়াও গ্রামে যত দেবী রয়েছেন, সকলকেই একসঙ্গে চতুর্দোলা করে শোভাযাত্রা বের হয়।
এমন কালী গ্রাম আরও রয়েছে বঙ্গে, একদা শশাঙ্কের রাজধানী কর্নসুবর্ন থেকে কিছু দূরে অবস্থিত গোকর্ণ গ্রাম, যা আজ কালীগ্রাম হিসেবে পরিচিত। অধুনা মুর্শিদাবাদের গ্রামে মোট ৪৮টি কালীপুজো হয়। একদা এখানে ছিল শশাঙ্কের গোশালা, তাই এর নাম গোকর্ণ। এখানে গোকর্ণেশ্বর শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। গ্রামটি শক্তিপুজোর জন্য প্রসিদ্ধ। প্রতিবছর গ্রামে কালীপুজো ঘিরে উৎসব চলে। একদা গ্রামে ৮০-৯০টি কালীপুজো হত। গ্রামটিকে কালীক্ষেত্র বলা হয়। গ্রামের প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে শ্যামরায় কালী, বড়িজ্যা কালী, গঙ্গাময়ী কালী, কোটাল কালী, বড়রায় কালী, ছোট কালীবাড়ির পুজো, বেনেকালী। এখানকার বড়িজ্যা কালী ঘিরে একটি লোককথা শোনা যায়, গ্রামের সব পুজো গভীর রাতে শুরু হলেও বড়িজ্যা কালীর পুজো সন্ধ্যায় শুরু হয়। শোনা যায়, একবার পুজোর সময় গ্রামের একটি শিশুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, গোটা রাত খুঁজেও শিশুটিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরদিন সকালে বড়িজ্যা কালীর মুখে ওই শিশুর পরনের কাপড়ের টুকরো দেখা যায়। তারপর থেকেই বড়িজ্যা কালীর পুজো শুরু হয় সন্ধ্যায় আর সূর্য ওঠার আগেই দেবীর নিরঞ্জন হয়। কালীপুজো ঘিরে বিসর্জনের দিন গোকর্ণ হাইস্কুল চত্বরে মেলা বসে। আতশবাজি প্রদর্শনী চলে।
দুর্গাপুরেও একটি কালীগ্রাম রয়েছে, সেখানেও অজস্র কালীপুজো হয়।
বুদবুদের ভট্টাচার্য্য পরিবারের কালীপুজো:
প্রায় তিনশো বছরেরও অধিক সময় যাবৎ বুদবুদের কোটা গ্রামের ভট্টাচার্য্য পরিবারের কালীপুজো চলে আসছে। ভট্টাচার্য্য পরিবারের দেবী কালী এখানে বড়মা কালী পরিচিত। মা কালীর উচ্চতা ২২ ফুট। ভট্টাচার্য্য পরিবারের পূর্ব পুরুষ মনোহর ভট্টাচার্য্য কাটোয়ায় গঙ্গা স্নান করতে যাওয়ার পথে, কাটোয়ার গৌরাঙ্গ ঘাটের পাশে শ্যামা কালীর মন্দির সংলগ্ন ধর্মশালায় স্নান করার পর সেখানেই তিনি বিশ্রাম করছিলেন। সেই সময় তিনি স্বপ্নাদেশ পান। মা কালী স্বপ্নাদেশে তাঁকে জানান, মা কালী তাঁর বাড়িতে গিয়ে পুজো নিতে চান। কিন্তু তিনি একজন গরীব ব্রাহ্মণ, তিনি কিভাবে বড় পুজোর আয়োজন করবেন; মনোহরবাবুর প্রশ্নের উত্তরে দেবী বলেছিলেন, শুধু পুজোর উদ্যোগ নিতে হবে তাঁকে, বাকি পুজোর ব্যবস্থা মা নিজেই করবেন। এরপর কাটোয়া থেকে কোটা গ্রামে ফিরে মনোহরবাবু তাঁর স্বপ্নাদেশের কথা তিনি পরিবার ও গ্রামের মানুষদের জানান। এরপরই গ্রামেরই এক কারিগর ২২ ফুটের মূর্তি তৈরি করে গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় সাড়ম্বরে পুজোর আয়োজন হয়। পুজোর আয়োজনে কোন মহিলা অংশগ্রহণ করতে পারেন না, দীর্ঘদিন ধরে এই রীতি চলে আসছে এখানে। শোনা যায়, দেবীর কাছে কেউ কোন মনস্কামনা করলে তাঁদের মনস্কামনা পূরণ হয়। পুজোর পরের দিন অন্ন ভোগ বিতরণ করার পর রাত্রিবেলায় দেবী প্রতিমা বিসর্জন করা হয়।
দুর্গাপুরের কল্যাণী কালী মন্দির:
অতিকায় কালী মূর্তি, দাম মাত্র এক টাকা! কালী মূর্তি তৈরি করতে মাত্র এক টাকা পারিশ্রমিক নেন কারিগররা। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলেই রয়েছে কল্যাণী কালী মন্দির। কাটোয়ার কাঁটাডি গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের মাতুলালয় ছিল দুর্গাপুরের আমরাই গ্রামে। সেই গ্রামই বন্দ্যোপাধ্যায়দের আবাসস্থল হয়ে ওঠে। ওই পরিবারেরই কন্যা ছিলেন কল্যাণী। তাঁর নামেই কালীমন্দির।
গ্রামের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত তামলা পুকুরে স্নান করতে গিয়ে একদিন তলিয়ে গিয়েছিলেন কল্যাণী। সেই দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই তামালা পুকুর পাড়ে গোটা গ্রাম জড়ো হয়। জেলেরা জাল ফেলে পুকুর তোলপাড় করেন। কিন্তু কল্যাণীর হদিশ মেলে না। ঠিক হয়, পুকুরের সমস্ত জল বের করে কল্যাণীর নিখোঁজ হওয়ার রহস্যের কিনারা করতে হবে। সেইসময় কল্যাণীর বাবা স্বপ্নাদেশ পান, খোঁজার প্রয়োজন নেই। কল্যাণী ঠিক বাড়ি ফিরে আসবেন, চিন্তার কোনও কারণ নেই। সূর্যোদয় হতেই মাথায় কলস নিয়ে কল্যাণীদেবীকে পুকুর থেকে উঠে আসতে দেখা যায়। পাশের গ্রাম কুরুরিয়ার এক ঢাকি স্বপ্নে দেখেন, তাকে দেবীপুজোর জন্য বাড়ুজ্জেদের বাড়ি ঢাক নিয়ে আসার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। সেই মতো ঢাকি বেণী বাদ্যকরকে নিয়ে পুকুরপাড়ে উপস্থিত হন। কল্যাণীকে দেবীরূপে বরণ করে নেয় গোটা গ্রাম। ঘটনার সাক্ষী হন সকলে। গ্রামের মানুষদের মুখে মুখে ছড়ায় কল্যাণী কালী মায়ের কথা।
বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা খড়ের একটি অস্থায়ী মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানেই ব্রহ্মকলস প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে আজও মাতৃকলস পূজিত হয়ে আসছে। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় মূর্তি নির্মাণ করে তন্ত্রমতে শক্তির আরাধনা করেন গ্রামের মানুষ। তাদের কাছে আজও কল্যাণী ব্রহ্মময়ী দেবী। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় ঐতিহাসিক তামলাপুকুর থেকে গন্ডি কেটে ভক্তরা আসেন সেই কালী মন্দিরে। সারাবছর নিত্যপুজো হলেও কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যায় বাৎসরিক পুজো উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে দেবীমূর্তি নির্মাণ করা হয়।
বংশপরম্পরায়, এক সূত্রধর পরিবারের সদস্যরা মূর্তি নির্মাণ করে চলেছেন। জনশ্রুতি রয়েছে, সূত্রধর পরিবারের ভাগ্যনিয়ন্তাও মা কল্যাণী। সেই কারণে দেবীমূর্তি গড়ার জন্য একটি পয়সাও নেন না তাঁরা। মূর্তি নির্মাণ করতে যে মাটি লাগে তাও আসে বিনামূল্যে।
বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা কারিগরের হাতে প্রতীকী মূল্য হিসেবে এক টাকা তুলে দেন। মাতৃবেদীতেই সেই টাকা কারিগর রেখে দেন। ভাইফোঁটার দিন এক মিলন মেলার শেষে মূর্তির বিসর্জন হত। এখন আর মেলা হয় না। কল্যাণীর নামেই দেবীর নাম হয়ে গিয়েছে, মা কল্যাণী কালী। আজও দেবীর পুজো চলে।