কৌশিকী অমাবস্যা তিথি এখনও রয়েছে। কালীপুজোর জন্যে আজকের দিনটির মাহাত্ম্য অপরিসীম। আজকের এই পুণ্যতিথিতে আমরা বঙ্গের আনন্দময়ী কালীদের কথা জানবো। নদীয়াতে এক মা আনন্দময়ী কালী মন্দির রয়েছে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি এই কালীমন্দিরের আনন্দময়ী মাকে নিয়ে জনশ্রুতির শেষ নেই। কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে বেরিয়ে আনন্দময়ী রোড ধরে মিনিট কুড়ির পথ পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে এই কালী মন্দিরে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির অনতিদূরে এই মন্দির অবস্থিত। মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলটি আনন্দময়ীতলা নামে পরিচিত। সাকো পঞ্জিকা অনুসারে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র মহারাজা গিরিশচন্দ্র, ১৮০৪ সালে মা আনন্দময়ীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শোনা যায়, মহারাজ গিরিশ চন্দ্র রায় ছিলেন তন্ত্রসাধক। রায় পরিবারই আজও এই মন্দিরের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে।এই মন্দিরটি সমতল-ছাদযুক্ত প্রায় ৪০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। এটি ইট দিয়ে তৈরি। মা আনন্দময়ীর সঙ্গে অন্যান্য দেবদেবীরও পুজো করা হয় এখানে।
মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। মন্দিরের গর্ভগৃহে হাঁটু মুড়ে যোগাসনের ভঙ্গিতে মহাদেব বিরাজমান। মহাদেবের বুকের উপর পদ্মাসনে বসে আছেন স্বয়ং মা আনন্দময়ী। মহাদেবের বিগ্রহটি শ্বেত পাথরে নির্মিত এবং দেবী আনন্দময়ীর বিগ্রহটি কষ্টিপাথরে নির্মিত। প্রায় সাড়ে তিন ফুটের উচ্চতা বিশিষ্ট দেবী মূর্তি রয়েছে এখানে। মাতৃমূর্তি চতুর্ভূজা। এছাড়াও মন্দিরে রয়েছে ছোট কালী মূর্তি, দেবী শীতলা ও অন্যান্য দেবদেবী বিগ্রহ। জনশ্রুতি রয়েছে, আনন্দময়ীর যে মূর্তি এখানে বিরাজমান সেই রূপের স্বপ্ন দেখেছিলেন রাজা গিরিশচন্দ্র রায়। বর্তমানে যেখানে দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানেই আগে প্রকাণ্ড একটি কষ্টিপাথর ছিল। সেই কষ্টি পাথর থেকেই মহারাজের স্বপ্নে দেখা রূপ অনুযায়ী দেবী বিগ্রহটি নির্মিত হয়েছে। শিলাখন্ড থেকে দুটি মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছিল। একটি আনন্দময়ী কালীর এবং অন্যটি ভবতারিণী কালীর। কৃষ্ণনগরের এই মন্দিরের দেবী আনন্দময়ীর অন্যান্য অনেক কালী মন্দিরের থেকে আলাদা। এই মন্দিরে মা আনন্দময়ীকে প্রতিদিনের নিত্য ভোগে মাছ দেওয়া হয়। যদি এমন পরিস্থিতি হয় যে বাজারে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, সেক্ষেত্রে কোন মাছের আঁশ হলেও তা মাকে দিতেই হবে। প্রথমে আনন্দময়ীর গায়ে কোনও বস্ত্র ছিলনা। পরবর্তীকালে ভক্তদের অনুরোধে মাকে বস্ত্র পরানো হয়।
অনেকেই মনে করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বপ্নদেশে মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই এই মন্দিরে নিত্য পুজো হয়ে আসছে। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, এই মন্দিরের মা আনন্দময়ী খুবই জাগ্রত। ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন দেবী। তাই ভক্তেরা দূর-দুরান্ত থেকে মা আনন্দময়ী পুজো দিতে আসেন। কালী পুজোর সময় বিপুল ভক্তসমাগম হয়। আনন্দময়ী দেবীর মন্দিরের রয়েছেন বাবা আনন্দময় অর্থাৎ শিব। নদীয়ার আনন্দময়ী কালীর মন্দিরটি একরত্ন। ভিতের সঙ্গে সংযোগ না রেখে টুঙ্গী বসিয়ে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরের চূড়া ছত্রাকৃতির এবং মন্দিরের দেওয়ালে মূর্তি খোদিত। গর্ভগৃহে পঞ্চমুণ্ডির আসনের ওপর পাথরের বেদীতে শায়িত শিব বিগ্রহ।
এবার চলুন উত্তরবঙ্গে। শিলিগুড়িতেও রয়েছে আনন্দময়ী কালীমন্দির। মন্দিরের ইতিহাস সুপ্রাচীন, স্বাধীনতা সংগ্রামে এই মন্দির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই মন্দিরে দুর্গাপুজোও হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় চারণ কবি মুকুন্দ দাসের কথা সকলের জানা। বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলকে তিনি নিজেদের গানের মাধ্যমে আন্দোলনে সামিল হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। ফলে ব্রিটিশের নজরে পড়ে গিয়েছিলেন। ১৯২৪ সালের মে মাসে বরিশাল থেকে পালিয়ে আসেন শিলিগুড়িতে। অধুনা শিলিগুড়ি থানার পিছনে টিনের তৈরি একটি কালীবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে সময় মন্দিরের অবস্থা দেখে, মন্দির সংস্কার করার উদ্যোগ নেন তিনি। গান গেয়ে ৫০১ টাকা জোগাড় করে মন্দির গড়ার জন্য দান করেছিলেন। মন্দির স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয় তার দুবছর পর। ১৯২৬ সালে স্বাধীনতার বহু আগে এই মন্দিরে প্রবেশ করেন মা কালী। আনন্দময়ী কালীমূর্তি কাশী থেকে আনা হযেছিল। উদ্যোক্তা মুকুন্দ দাস নিজেই। নামটাও নিজেই রেখেছিলেন আনন্দময়ী কালীবাড়ি এভাবেই শুরু হয় মন্দিরের পথচলা।
পুজোর সময় দেশের ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে মন্দিরে বিপ্লবীরা আসতেন। মন্দির প্রাঙ্গণে চলত শরীরচর্চা, ব্যায়াম। বৈঠক বসত। বিপ্লবীরা এই মন্দিরেই ব্রিটিশ রাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার একাধিক পরিকল্পনাও করতেন। কুস্তির আসর বসত। প্রায় শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মন্দির।
খাস কলকাতাতেও রয়েছে শ্রীশ্রীআনন্দময়ী কালীবাড়ি। হুগলি নদীর তীরবর্তী নিমতলা মহাশ্মশানের পাশেই এই মন্দির অবস্থিত।নিমতলা মহাশ্মশানে শেষকৃত্যের জন্য আনা শবদেহগুলিকে এই মন্দিরের সামনে রেখে মৃতের আত্মার প্রতি শান্তি প্রার্থনা রেওয়াজ রয়েছে। শোনা যায়, অতীতে কোন এক কালীসাধক শ্মশানের ধারে একটি ছোট কুটিরে কালী পুজো করতেন। সেই কুটিরেই তিনি আনন্দময়ী কালীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সেখানেই মন্দির গড়ে উঠেছে।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা এক ভক্ত জনৈক জগন্নাথকে মন্দিরের পুজোর ভার দিয়েছিলেন। কিন্তু জগন্নাথের সঙ্গতি না থাকায় তিনি নারায়ণ মিশ্র নামের এক ব্রাহ্মণের কাছে মন্দিরটি বিক্রি করে দেন। নারায়ণ মিশ্রের বড়ো ছেলের মৃত্যুর পর তার মেয়ের ঘরের দৌহিত্র জমিদার মাধবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই মন্দিরের সত্ত্বাধিকারী হন। তিনিই স্থায়ী মন্দির নির্মাণ করান। এই মন্দিরের স্থাপত্য দোতলা চাঁদনি প্রকৃতির। মন্দিরের চূড়া নেই। মন্দিরের কাছেই আটচালা শৈলীর শিব মন্দির রয়েছে।
আনন্দময়ী মন্দিরের আদি কালীবিগ্রহটি ছিল মাটির শ্মশানকালীর বিগ্রহ। বর্তমান মূর্তিটি কষ্টিপাথর নির্মিত দক্ষিণাকালীর মূর্তি। বিগ্রহের মাথায় সোনার মুকুট এবং জিভটিও সোনার তৈরি। উচ্চতায় দুই ফুট। পঞ্চমুণ্ডের আসনের উপর স্থাপিত রূপোর সিংহাসনে মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। মাতৃ মূর্তি সালঙ্কারা ও পট্টবস্ত্রপরিহিতা।প্রতিবছর বুদ্ধপূর্ণিমায় পুষ্পদোল উৎসবের আগে মূর্তির অঙ্গরাগ করা হয়।
বর্ধমানের বুদবুদের মানকরে রয়েছে ৩৫০ বছরের পুরানো আনন্দময়ী কালী মন্দির। বুদবুদের মানকরের এই পুজো কবিরাজ বাড়ির পুজো হিসাবেই পরিচিত। এই মন্দিরে মা কালীকে মহামায়া রূপে পুজো করা হয়। এই পুজোর সূচনা করেছিলেন রাজবল্লভ গুপ্ত। সারা বছর পুজো হলেও কালিপুজোর সময় বিশেষভাবে জাঁকজমক করে পুজোর আয়োজন করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে বলি প্রথা চালু রয়েছে। পাঁঠা বলির পাশাপাশি চাল কুমড়ো এবং আখ বলি দেওয়া হয়। মন্দিরে দেবী মূর্তি এখানে কষ্টি পাথর নির্মিত। ৩৫০ বছর আগে দেবীকে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসানো হয়, সেই থেকেই দেবী পঞ্চমুণ্ডির আসনেই পূজিতা।
হুগলির সুখারিয়া গ্রামে রয়েছে মা আনন্দময়ীর মন্দির। হুগলি জেলার সোমড়া অঞ্চলের মা আনন্দময়ীর মহিমা বিস্ময়ের জন্ম দেয়। মা এখানে ভৈরবী রূপে পূজিত হন। সম্পূর্ণ টেরাকোটার মন্দিরে মায়ের আদল একেবারেই জগৎজননী স্বরূপ।
১১৭০ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে মায়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন মায়ের বিশেষ আরাধনা হয়। কথায় বলে, মা আনন্দময়ীরা তিন বোন, অন্য দুজন হলেন মা নিস্তারিণী এবং হরসুন্দরী। অনতিদূরেই তারা প্রতিষ্ঠিত। আনন্দময়ী মায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জমিদার শ্রী বীরেস্বর মিত্র মুস্তাফি। স্বপ্নাদেশ পেয়েই গঙ্গার ধারে কষ্ঠিপাথরের মূর্তি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।আনন্দময়ী এখানে ভৈরবী এবং পঞ্চমুণ্ডের আসনে মহাদেবের উপর অধিষ্ঠাত্রী।
দক্ষিণেশ্বর ভবতারিণী মন্দির এই মন্দিরের আদলেই গঠিত। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৮৫০ নাগাদ কাশী যাত্রার সময় নাকি রানি রাসমণি গঙ্গা দিয়েই যাওয়ার সময় এই মন্দিরটিকে দেখেন, দেখেই তাঁর পছন্দ হয়। ২৫টি চূড়া বিশিষ্ট পঞ্চরত্নের মন্দির এবং দুই দিকে মহাকাল পাহারায় ঘিরে রেখেছেন মা আনন্দময়ীকে। সুনিপুণ টেরাকোটার কাজ। প্রচলিত বিশ্বাস, মায়ের কাছে মনোবাঞ্ছা নিয়ে এলে খালি হাতে কেউ ফেরে না। গ্রামের বাসিন্দাদের বিশ্বাস এই জায়গার মাহাত্ম্য অসীম মায়ের মুখ দেখলেই দিন ভাল যায়। মায়ের উদ্দেশ্যে ফুল না দিয়ে স্থানীয়রা জল স্পর্শ করেন না। শোনা যায় মন্দিরের পাশের পুকুরেই নাকি সোনার নোলক পড়া মাছ আছে। যা মন্দিরের সমৃদ্ধির প্রতীক।