আপেল কামড়ানো মানুষটার অন্দরে

চমৎকার! চমৎকার! চমৎকার!  চোখ বোজার আগে এই ছিল তাঁর শেষ উচ্চারিত কথা।নিজের সন্তানসম কোম্পানি থেকে বিদায় জানানো হয়েছিল সর্বকালের অন্যতম সেরা এই প্রযুক্তিবিদ্‌ কে।তাঁর জীবন বাঁচাতে নিজের যকৃতের অংশ কেটে দিতে চেয়েছিলেন সেই কোম্পানিরই  কর্ণধার।এভাবেই একবার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা- সেখান থেকে বিতারন- আবার ফিরে এসে দেউলিয়া কোম্পানির হৃত গৌরব উদ্ধার। তিনি একাধারে ত্রাতা, প্রযুক্তিবিদ্‌, দূরদর্শী, বাগ্নী...আরও যে কত কী!একজন আমেরিকান উদ্ভাবক, ডিজাইনারঅ্যাপেল কম্পিউটারের সহ উদ্যোক্তা, সিইও ও চেয়ারম্যান। অ্যাপেল এর বিশ্বখ্যাত পন্য আইপড, আইপ্যাড, আইফোন, আইম্যাক এর প্রধান কারিগর। এক কথায়, তিনি স্টিভেন পল জোবস।  একজন শিল্পী যখন হন উদ্যোক্তা।পৃথিবীর  প্রযুক্তির ভূগোল পাল্টে ফেলা মানুষটির সামনে পরীক্ষার খাতাও কম আসেনি। মাঝ পথে কলেজ কে বিদায় জানালেও,জীবনের অন্যান্য পরীক্ষাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন বুক চিতিয়ে।জন্মে নরম আঙুল স্পর্শ যে বুক, তিনি ছিলেন সৎ মা। আর্থিক তাড়নায় নিজের মা কোলে নেননি সদ্য জন্মানো স্টিভকে। সাতাশ বছর পর জানতে পেরেছিলেন সেই সত্যি।

steve1

পড়াশুনা না করলেও ফলাফল তাঁর বরাবরই ভালো ছিল। স্কুল কতৃপক্ষ বয়স হওয়ার আগেই তাঁর বাবা-মায়ের কাছে তাঁকে হাইস্কুলে উঠিয়ে দেয়ার প্রস্তাব রাখেন। তাঁকে পড়াশুনা করানোর জন্য তাঁর চতুর্থ শ্রেণীর এক শিক্ষক তাঁকে ঘুষ পর্যন্ত দিয়েছিলেনবন্ধু স্টিভ ওজনিয়াক কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির গ্যারাজেই ঘটিয়ে ফেললেন নতুন প্রযুক্তি বিপ্লব। বাকি ঘটনা আজ ইতিহাস হয়ে মুখে মুখে ফেরে।জোবস নিজের ভোক্সওয়াগন গাড়ি এবং ওজনিয়াক নিজের প্রিয় সাইন্টিফিক ক্যালকুলেটর বিক্রি করে প্রাথমিক মূলধনের যোগান দেন।তাঁর জীবন সিনেমার গল্পের প্রতিচ্ছবি। ছেলেবেলায় পালক পিতার সঙ্গে  পারিবারিক গ্যারাজে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতেন। নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদ সেই থেকেই।

আটারি’র হয়ে একজন ভিডিও গেম ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন কিছুদিন। কয়েক মাস পরে  আধ্যাত্মিক মুক্তি খোঁজার জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন ভারতে। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। কোনো এক মঠের সন্ন্যাসী হয়ে জীবন কাটানোর চিন্তাভাবনাও ছিল প্রযুক্তি সম্রাটের!দ্রুত রেগে যাওয়া ছিল তাঁর স্বভাব। এই রাগই  হয়ে দাঁড়ায় কাল। ওজনিয়াকের সঙ্গে ছিন্ন হল সম্পর্ক । এরই মাঝে  বান্ধবী ক্রিসান বার্নান এর সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে  জন্ম হয় লিসার

steve2

যদিও স্টিভ লিসাকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করেননা। লিসার জীবনও হয়ে ওঠে অভাব পীড়িত। ব্যক্তিজীবন যখন তাঁর সবচেয়ে অগোছালো, তখনই  বাজারে আনেন অ্যাপল-৩ ।তবে এবার আর মন যোগাতে পারলেননা সাধারন মানুষের।মনে একপ্রকার জেদ নিয়ে আবারও মাথে নামলেন। এবারে ম্যাকিন্টশ। ভাগ্য এবারও সহায় হলো না। ম্যাকিন্টশ ফ্লপ। কপালে জুটল বহিস্কার।আলাদা ভাবে শুরু করলেন নেক্সট। সাফল্য আসেনা সেখানেও। তবে অসফলতার ভিড়েই খুঁজে পান  সাফল্যের সিড়ি । নেক্সট চালু করার এক বছর পর ১৯৮৬ সালে জোবস লুকাস ফিল্মের গ্রাফিক্স ডিপার্টমেন্ট ‘দ্য গ্রাফিক্স গ্রুপ’ কিনে নেন।

নাম রাখলেন পিক্সার । সেবছরই পিক্সার থেকে তাদের প্রথম অ্যানিমেশন ছবি ‘লুক্সো জুনিয়র’ মুক্তি পায়। ব্যবসায়িক সফলতা আর প্রশংসা একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে আসে।১৯৯১ সালে পিক্সার স্টুডিও ডিজনির সাথে একটি চুক্তি সই করে। এই দুই স্টুডিওর মিলিত ব্যানারেই ১৯৯৫ সালে মুক্তি পায় পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার দ্বারা তৈরি অ্যানিমেশন মুভি ‘টয় স্টোরি’জোবস হয়ে গেলেন পিক্সারের ৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ।স্টিভ কে ছেড়ে অ্যাপেল ততদিনে ধুঁকছে। দেউলিয়া হতে থাকা কোম্পানি আবার ফিরিয়ে আনল তাদের পথপ্রদর্শক কে। জোবসের জাদু ছোঁয়ায় আবারও মানুষের মনে জায়গা করে নেয় অ্যাপেল। 

steve3

জোবসের নতুন পদ হয় আই সি ই ও (Informal Adviser to the CEO)।মারণ কর্কট রোগ মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সেই তাঁকে কেড়ে নিল জীবন জুদ্ধের দোলাচল থেকে। অনেকদিন লড়াই চলছিল ক্যান্সারের সঙ্গে। শেষমেশ বিদায় জানালেন ২০১১ সালে।লক্ষ্যহীন একজন শিশুও পাল্টে ফেলতে পারে পৃথিবীর মানচিত্রের নকশা। জীবনে চলার পথের সমস্ত অভিজ্ঞতা থেকে রঙ সঞ্চয় করে নিতে হয়।এভাবেই চলতে হয় আগামী পথ।শেষ শয্যায় গিয়ে সম্পূর্ণ হয় ছবি। এভাবেই। তাঁর কথা টেনেই বলা চলে,

স্টে হাংরি, স্টে ফুলিশ!  

খিদে নিয়ে থাকুন, বোকা হয়ে বাঁচুন। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...