কোনো এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে কোনো গথিক চার্চে প্রবেশ করলে তা অন্যান্য দিনের তুলনায় হয় অনেকটাই অন্যরকম। সূর্যের আলো যখন চার্চের রঙিন কাঁচ ভেদ করে ভিতরে আসে তখন তার লাল-নীল-সবুজ কিরণে স্নাত হয় চার্চ। জানালায় কাঁচ লাগানো তো খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু সেই কাঁচই যখন হয় রঙিন তখন তা চার্চের শোভা বাড়িয়ে দেয়।
এই ধরণের কাঁচকে বলা হয় ‘স্টেইন্ড গ্লাস’, এরকম অনেক ছোট কাঁচের অংশকে জুড়ে তৈরী হয় একটি ছবি বা ডিজাইন। এই কাঁচের মধ্যেই অনেকক্ষেত্রে ফুটে ওঠে নানারকমের গল্প-কাহিনী যেখানে বর্ণিত থাকে যীশুখ্রীষ্টের জীবনের নানা ইতিবৃত্ত। তাঁর জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটা পর্যায় নিপুণভাবে বর্ণিত হয় এখানে। এর অঙ্কনপদ্ধতি হয় ভিন্ন, কাঁচের মাধ্যমে সৃষ্ট চরিত্রগুলির একই অংশে একই রঙে দুয়ের বেশী শেড-এর ব্যবহার অনেক কম পরিলক্ষিত হয়। শিল্পীরা চরিত্রগুলিকে দেয় থ্রি-ডাইমেনশন। হলুদ রঙের ব্যবহার তুলনামূলক বেশী ডিজাইনকে আরো দৃষ্টিনন্দন করে তোলে। আউটলাইন খুব প্রয়োজনীয় এবং প্রচলিত। জিওমেট্রিক শেপ এর যথেচ্ছ ব্যবহার দেখা যায়।
একটি বড় সাদা বোর্ডে, কারিগর জানালার মাপে একই আকার একটি ছবি আঁকেন। তারপর তিনি রঙ অনুযায়ী ছবির প্রতিটি অংশকে বিভিন্ন সংখ্যায় ভাগ করেন। অঙ্কনের উপর এরপর রঙিন কাঁচের টুকরো রাখা হয় যা আগেই অর্থাৎ কাঁচ তৈরীর সময় ধাতব অক্সাইড দিয়ে রঙ করে নেওয়া হত। তারপর, অঙ্কন রূপরেখা অনুসরণ করে একটি গরম লোহা দিয়ে কেটে নেওয়া হয়। অবশেষে শিল্পী কাচের টুকরোগুলি মাপসই করে সীসা দিয়ে একসঙ্গে জুড়ে দেয়, এই সীসা টুকরোগুলি ধরে রাখার সাথে সাথে নকশার একটা অংশ হয়ে ওঠে। তবে সময়ের সাথে এই পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে অনেক, এসেছে অনেক উন্নততর উপায়।
হাজার হাজার বছর আগে থেকেই এই রঙিন কাঁচ ব্যবহৃত হয়ে আসছে চার্চে ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। ইজিপশিয়ান ও রোমানরা প্রথম এই কারিগরি-দক্ষতা অর্জন করে। এই কাজটির ক্ষেত্রে অঙ্কনদক্ষতা যতটা মূল্যবান ঠিক ততটাই প্রয়োজন ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতা যা টুকরো অংশগুলিকে একত্রিত করে গল্পের আকার দেয়। রিফর্মেশন এর দরুন ইউরোপ ও অন্যান্য জায়গায় এই স্টেইন্ড গ্লাসের বদলে প্লেন গ্লাস অর্থাৎ এক রঙের কাঁচ লাগানো হয় কিন্তু পরবর্তীকালে ১৮০০ সাল নাগাদ ক্রমশ ব্রিটেন, ফ্রান্স ইত্যাদির একাধিক চার্চে আবার পুনরাবির্ভাব ঘটে স্টেইন্ড গ্লাসের। ফিরে আসে হারিয়ে যাওয়া শিল্প। সময়ের সাথে সাথে এতে আসতে থাকে নানা রকম নতুন সংযোজন।
এই স্টেইন্ড গ্লাস ব্যবহারের কারণ রয়েছে একাধিক। এটির ব্যবহার শুরু হয়েছিল চার্চে অতিরিক্ত সূর্যালোক প্রতিরোধ করার জন্য। অপরদিকে এই নানান রঙের কাঁচ ও সূর্যকিরণের খেলায় চার্চের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য্য অনেক বেড়ে যেত। তারই সাথে আরাধ্য যীশুর জীবনকাহিনী খুব সহজবোধ্যভাবে পৌঁছে যেত ভক্ত বা অন্যান্য সাধারণ মানুষের কাছে। এভাবেই প্রাচীনকালে তা হয়ে উঠত যোগাযোগের একটা খুব সহজ মাধ্যম। আর এই যোগাযোগের মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষাপ্রদান।