মানবী-পুজো এবং এক উত্তরণের গল্প

১৮৬১ সালের মাঝামাঝি। ভৈরবীর নৌকো এসে ভিড়ল দক্ষিণেশ্বরে। মন্দিরের গায়ে, বকুলতলার ঘাটে। ভৈরবীর পরনে উজ্জ্বল গেরুয়া, আলুলায়িত চুল, কণ্ঠে লাল শালুতে বাঁধা ইষ্টদেবতা রঘুবীর-শিলা। তাঁকে দূর থেকে দেখতে পেলেন রামকৃষ্ণ। ভাগ্নে হৃদয়কে বললেন ডেকে আনতে। ভৈরবী এলেন। মুখে তাঁর মৃদু হাসি। বললেন, তুমি না-ডাকালেও, আমি তোমার কাছেই আসতাম। মা নিজেই যে তোমার কাছে আমায় পাঠিয়েছেন, বাছা!

'মা' মানে, দেবী জগদম্বা। তিনি খামোখা ভৈরবীকে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে পাঠালেন কেন? কী অভিপ্রায়ে?

শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবজীবনে দেবী-মায়ের জন্য আকুতি-সমাধি-মূর্ছা; সে-সময় অনেকের মতো রানির জামাই মথুরের কাছেও নেহাত 'রোগলক্ষণ' বলে মনে হয়েছিল। ভৈরবীই প্রথম মথুরকে বুঝিয়ে দিলেন, এ-হচ্ছে তাঁদের 'ছোট ভটচায'-এর 'আবেশ', যে আবেশ কৃষ্ণবিহনে শ্রীরাধার আসত, শ্রীচৈতন্যের আসত, তেমনি দেবীমায়ের জন্য এঁরও আসে।  শ্রীরাধা ও শ্রীচৈতন্য চেয়েছিলেন ইষ্টের সাথে এক হতে, এঁর সাধনাও তা-ই।

হঠাৎ একদিন ঘটল এক দারুণ ঘটনা বেলা দুই প্রহর হতে-না-হতেই আর পাঁচ দিনের মতোই ভৈরবী সেদিন তাঁর ইষ্টদেবতা রঘুবীরকে অন্নভোগ নিবেদন করলেন। তারপর ধ্যানমগ্ন হলেন। চোখের জলে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে লাগলেন তাঁকে। ওদিকে ঠিক তখনই নিজের ঘরে বসে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাবেশ এলো, বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে তিনি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ধ্যানস্থ ভৈরবীর কাছে। বসে পড়লেন মেঝেতে। তারপর খেতে লাগলেন রঘুবীরকে নিবেদিত নৈবেদ্য। কিন্তু, হঠাতই তাঁর আবেশ কেটে গেল। চেতনা ফিরল। আর চেতনা ফিরতেই তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। ওমা, ভৈরবীর কাছে আবার কখন এলুম! হাতে অন্ন, মুখে অন্ন, সামনে উচ্ছিষ্ট অন্নভোগ। হায়, হায়, এ আমি কী করলুম! রঘুবীরের অন্ন উচ্ছিষ্ট করলুম! বড্ড ভুল হলো তো, বড্ড ভুল হলো তো!--বলতে বলতে তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো চলে গেলেন। ততক্ষণে ভৈরবীরও অবশ্য ধ্যান ভঙ্গ হয়েছে। তিনি সব দেখেছেন, সব শুনেছেন। আর সব দেখেশুনেই তাঁর মনে অন্য এক ভাবের উদয় হল। তাঁর মনে হল,  দক্ষিণেশ্বরের ছোট ভটচাযের রূপ ধরে ওই নৈবেদ্য যেন স্বয়ং রঘুবীর-ই এসে গ্রহণ করলেন। যেমন, কৃষ্ণরূপে অতিথির প্রার্থনায় গ্রহণ করেছিলেন, নিমাইরূপে তৈর্থিক ব্রাহ্মণের প্রার্থনায় গ্রহণ করেছিলেন, এখানেও যেন তেমনটাই হল। আসলে, ভৈরবী উপলব্ধি করলেন, কালে কালে নরের মাঝেই অবস্থান করেন নারায়ণ। এতদিনে ঠাকুরকে হৃদয়ে উপলব্ধি করলেন। তাঁকে যেন পেলেন। আর শিলার ঠাকুরে কী হবে? তাকে তিনি গঙ্গায় বিসর্জন দিলেন। 

শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে ভৈরবীর যেমন উপলব্ধির স্তরটি উন্মোচিত হল, তেমনি ভৈরবীর সান্নিধ্যেও রামকৃষ্ণ উপলব্ধি করলেন নারীর মধ্যে শাশ্বত জগদম্বাকে। ভৈরবীর যত্নে তিনি পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে বীরভাবের তন্ত্রসাধনার প্রতিটি স্তর পেরিয়ে উপলব্ধি করলেন নারীর মধ্যে মায়ের রূপ। ‘শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’-গ্রন্থে স্বামী সারদানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের এই সাধনার কথা বলতে গিয়ে বলছেন, ‘রমণীমাত্রে মাতৃজ্ঞান সর্বতোভাবে অক্ষুন্ন রাখিয়া তন্ত্রোক্ত বীরভাবে সাধনসকল অনুষ্ঠান করিবার কথা আমরা কোনও যুগে কোনও সাধকের সম্বন্ধে শ্রবণ করি নাই।’ শক্তিগ্রহণ বা নারীসঙ্গম ছাড়া জগদম্বাকে প্রসন্ন করা অসম্ভব--প্রচলিত এই ধারণার বিপরীতে হেঁটে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রমাণ করেছেন, মাতৃভাবের সাধনাটাই বড় সাধনা।

 সেবার বাঁকুড়ার ইন্দাস থেকে দক্ষিণেশ্বরে এলেন তান্ত্রিক গৌরী পণ্ডিত এলেন পণ্ডিত্যের দাম্ভিকতা আর সিদ্ধাইয়ের অহং নিয়ে। কিন্তু, শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে ধীরে ধীরে সঙ্গগুণে দাস্যভাবে বিভোর হলেন। অন্যদিকে শ্রীরামকৃষ্ণও গৌরীর সান্নিধ্যে পেলেন তাঁর বহুদিনের সাধনার খোঁজ, অনন্য এক ভক্তিপথ। সেই পথটি কী? স্বামী সারদানন্দ লিখছেন, ‘ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি, গৌরী প্রতি বৎসর দুর্গাপূজার সময় জগদম্বা পূজার যথাযথ সমস্ত আয়োজন করিতেন এবং বসনালঙ্কারে ভূষিতা করিয়া আলপনাদেওয়া পীঠে বসাইয়া নিজের গৃহিণীকেই শ্রী শ্রীজগদম্বা জ্ঞানে তিন দিন ভক্তিভাবে পূজা করিতেন। তন্ত্রের শিক্ষা—যত স্ত্রী-মূর্তি, সকলেই সাক্ষাৎ জগদম্বার মূর্তি—সকলের মধ্যেই জগন্মাতার জগৎপালিনী ও আনন্দদায়িনী শক্তির বিশেষ প্রকাশ।’

শ্রীরামকৃষ্ণও স্ত্রী সারদাদেবীর মধ্যে সেই জগন্মাতাকে খুঁজতে চাইলেন। শুরু করলেন ষোড়শোপচারে পুজো। সেটা ১৮৭৩ সাল, জ্যৈষ্ঠ মাস কৃষ্ণাচতুর্দশী, ফলহারিণী কালীপূজার দিন। সারদা সেদিন দেবী জগদম্বার মতো বসন-অলঙ্কারে ভূষিতা হয়ে অধিষ্ঠান করলেন আলপনা আঁকা পিঁড়িতে। তাঁকে ‘ত্রিপুরেশ্বরী’ সম্বোধন করে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন; শুরু করলেন পুজো। সারদার চরণে সমর্পণ করলেন সমস্ত জীবনের সাধনার ফল আর ইষ্টনামজপের মালা। জীবনসর্বস্ব উৎসর্গ করে সারদার মধ্যে জগজ্জননীকে আবাহন করলেন। 'মা সারদা'-রূপে তাঁকে এগিয়ে দিলেন জগৎকল্যাণের পথে। বললেন, আমি অর্ধেক করে গেলুম, তুমি অর্ধেক করো...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...