যত মত তত পথের দিশারী রামকৃষ্ণ সম্পর্কে প্রবাসী পাত্রিকায় রবি ঠাকুর লিখেছিলেন,
“বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা
ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা।”
প্রকৃত অর্থেই বহু সাধকের বহু সাধনা এসে মিলিত হয়েছিল পরমহংস নামের মহাসাগরে। ধর্ম নামক সত্যের কাছাকাছি পৌঁছতে তিনি নানান পথ অবলম্বন করেছিলেন। ভিন্ন ধর্মাচরণ করতেও পিছপা হননি। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর দাদার সহযোগী হিসাবে, নিছক পৌরহিত্যের কাজে। তখনও তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বেড়াজাল মুক্ত হতে পারেননি। জাতিতে মাড় রানি রাসমণির হাতের অন্ন খাননি, এমনকি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন তিনি বলেছিলেন, কৈবর্ত্য রানির হাতে তিনি খাবেন না। মন্দিরে থাকাকালীন বেশ কিছু দিন তিনি নিজেই গঙ্গা পাড়ে নিজের খাবার পাক করতেন। এহেন গদাধর হয়ে উঠলেন প্রেমের ঠাকুর। অকাতরে বিলিয়ে দিলেন তাঁর অমৃতের ভাণ্ডার। শিখিয়ে গেলেন অমৃতের সন্তান হয়ে ওঠার মন্ত্র। তাঁর হাতিয়ার ছিল লোক শিক্ষা। নিজেকে কখনওই ভগবান বা ঈশ্বর, এমনকি অবতার অবধি বলেননি। কালীর ব্যাট হয়েও ভোগ করেছেন রোগ, ব্যাধি, জ্বরা। সব ধর্মের প্রতি তাঁর সমান শ্রদ্ধা ছিল। একে নিছক সেক্যুলারিজমের আওতায় ফেলা যায় না। আদপে ধর্মের তত্ত্ব উপলব্ধি করে তিনি বুঝেছিলেন, যত্র জীব তত্রই শিব।
ধর্মের সারকথাটি সহজ, সরল ভাবে বলে গিয়েছেন পরমহংস দেব। হুগলির কামারপুকুর গ্রামের চাটুজ্জে বাড়ির ছেলেটি সব রকম ধর্মের বেড়াজাল পেরোতে পেরেছিলেন। সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি তাঁর অমৃতবাণী ছড়িয়ে গিয়েছেন। কার্যত ধর্মের সত্য সন্ধান করেছিলেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ। বিভিন্ন ধর্মমতে সাধনা করেছিলেন। হিন্দু হয়েও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
জানা যায়, একদা ইসলাম ধর্মের সাধনা করেছিলেন ঠাকুর। গুরু হিসেবে বেছে নেন গোবিন্দ রায়কে। গোবিন্দ রায় ছিলেন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তাঁর নাম হয় ওয়াজেদ আলি খান। গোবিন্দ রায়ের কাছেই ইসলামের পাঠ নেন ঠাকুর। গোবিন্দ রায় ছিলেন সুফি সাধক। সাধনার সময় মন্দিরে পুজো করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন ঠাকুর। হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি বা ছবির দিকেও তাকাতেন না রামকৃষ্ণ। মন্দিরের বাইরে বসবাস করতেন। দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের বাইরে রয়েছে গাজীপীরের স্থান। গাজিপীর স্বপ্নে দর্শন দিয়েছিলেন স্বয়ং রাসমণিকে। পরে রানিমা তাঁর স্থানে বাতি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
ঠাকুরের নিজের কথায়, “বটতলায় ধ্যান করছি, দেখালে একজন দেড়ে মুসলমান সানকি করে ভাত নিয়ে সামনে এলো। সানকি থেকে ম্লেচ্ছদের খাইয়ে আমাকে দুটি দিয়ে গেল। মা দেখালেন, এক বই দুই নাই। সচ্চিদানন্দই নানা রূপ ধরে রয়েছেন। তিনিই জীবজগৎ সমস্তই হয়েছেন। তিনিই অন্ন হয়েছেন।”
নিয়মিত নমাজ পড়তেন, মসজিদে যেতেন ঠাকুর। কথামৃত অনুযায়ী, “গোবিন্দ রায়ের কাছে আল্লা মন্ত্র নিলাম। কুঠিতে প্যাঁজ দিয়ে রান্না ভাত হলো। খানিক খেলুম।” তিনদিন ইসলাম ধর্মে গভীর সাধনা করেন ঠাকুর। সিদ্ধিলাভ করেন। তিনদিনের সাধনার পর, এক সৌম্যদর্শন ফকিরের সঙ্গে দেখা হয় ঠাকুরের। দু’জনেই দু’জনকে দেখে বিভোর হয়ে যান। ঠাকুরের মনে হয় তিনি মহম্মদের দর্শন পেয়েছেন। শুধু মুসলমান ধর্মেই নয়, খ্রিস্ট ও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেও তিনি সিদ্ধিলাভ করেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
রামকৃষ্ণ একাধিক ধর্মের পথ অবলম্বন করেছিলেন, বলা ভালো অনুশীলন করেছিলেন। তার মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মও ছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, “যাঁকে কৃষ্ণ বলা হয়, তিনিই শিব এবং তিনিই আদ্যাশক্তি, যীশু ও আল্লাহ্ নামে পরিচিত - এক রাম, তাঁর হাজার নাম।”
যদু মল্লিকের বাগানবাড়ির বৈঠকখানায় যীশুর ছবি দেখে ভাবসমাধিস্থ হয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর। তাঁর ভক্ত শম্ভুচরণ মল্লিক তাঁকে বাইবেলের কাহিনি শোনাতেন। যীশুর প্রভাব এক সময় এতটাই পড়েছিল যে, কালীঘরে যাওয়া ক'দিনের জন্য বন্ধ রেখেছিলেন পরমহংস। বলতেন, তাঁর সঙ্গে যীশুর সাক্ষাৎও হয়েছে। ভক্তদের মধ্যে কেউ যদি বলতেন “আপনার সঙ্গে যীশুর মিল রয়েছে”, তাহলে শিশুর মতো আল্লাদে আটখানা হয়ে শুনতে চাইতেন, “কী কী মিল আছে?” দক্ষিণেশ্বরে নিজের ঘরে যীশুর ছবি রেখেছিলেন, তাতে সকাল-সন্ধ্যে ধূপধুনো পড়ত।
তোতাপুরীর শিষ্য কালীর সাধক হয়েও কৃষ্ণপ্রেমেও পড়েছিলেন। রাধা ভাবের আবেশে তিনি নারী সেজে কৃষ্ণ বিরহের যাতনা সয়েছেন। শাক্ত সাধকের কৃষ্ণপ্রেমের সাক্ষী গোটা দক্ষিণেশ্বর।
সর্বধর্ম সমন্বয়ের সার কথা যা ভারতের ঐতিহ্য, তা-ই বয়ে নিয়েই এগিয়েছেন ঠাকুর। পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর গুরুর সেই সহিষ্ণুতা ও সকলকে গ্রহণ করার উদার মনের কথাই প্রচার করেছেন। হিন্দু মন্দিরের এক পুরোহিতের পরিচয় ছাপিয়ে, রামকৃষ্ণ অনন্য হয়ে আছেন আজও। কারণ একটিই তাঁর মানবপ্রেমের অসীম ক্ষমতা।
তথ্যঋণ:
শ্রীরামকৃষ্ণজীবনে ইসলাম - স্বামী প্রভানন্দ