১৮৩৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলার ৬ ফাল্গুন ১২৪২ বঙ্গাব্দে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে সূর্যোদয়ের ১২ মিনিট পূর্বে পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের আর্বিভাব ঘটে। আজ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ১৮৯ তম জন্মতিথি।
হুগলীর কামারপুকুরে পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মা চন্দ্রমণি দেবীর চতুর্থ ও শেষ সন্তান। হুগলী জেলার আরামবাগ সাব ডিভিশনের গোঘাটের ২ নং ব্লকে অবস্থিত কামারপুকুর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জণ্মস্থান ও জীবনের প্রথম পর্বের লীলাভূমি হিসাবে বিখ্যাত। বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশন এবং মঠ অবস্থিত।
প্রতি বছর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের জন্মতিথি উপলক্ষে উৎসবে মেতে ওঠে কামারপুকুর। চলতি বছরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আজ, মঙ্গলবার থেকে তিনদিন ব্যাপি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মতিথি ও উৎসব শুরু হয়েছে কামারপুকুরে।
এদিন ভোর সাড়ে চারটের সময় মঙ্গলারতি ও বেদ পাঠের মাধ্যমে আজকের দিনটি সূচনা হয়। তারপর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ, বিশেষ পুজো ও চণ্ডীপাঠ অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সাড়ে সাতটায় এক বিশেষ শোভাযাত্রা কামারপুকুর এলাকা পরিক্রমা করে। যেখানে প্রচুর ভক্ত শোভাযাত্রায় পা মেলান। হাজার হাজার মানুষ কামারপুকুরে উপস্থিত হয়ে ভক্তি নিবেদন করেন।
কামারপুকুর ভক্তদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ভক্ত বৃন্দ আসেন এই স্থান পরিদর্শনের জন্য। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বাস-ঘর, রঘুবীরের মন্দির, বৈঠকখানা ও আম গাছ, ঠাকুরের জণ্মস্থান, যোগী এর শিব মন্দির, হালদার পুকুর, গোপেশ্বর শিবের মন্দির, ধনী কামারানীর জণ্মস্থান এবং মন্দির ইত্যাদি একাধিক দর্শনীয় স্থান আছে। আসুন জেনে নিই কী কী দেখবেন কামারপুকুরে-
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বাস-ঘর
কামারপুকুরের প্রাঙ্গনের পশ্চিম দিকের দক্ষিণ মুখী ঘরে ঠাকুর বাস করতেন, এখন সেটি মন্দির প্রাঙ্গনের একটি অংশ। একদা তিনি মা সারদা কে বলেছিলেন “আমার মৃত্যুর পরে, তুমি কামারপুকুরে থাকবে, সবুজ শাক সব্জী চাষ করবে, সহজ ভাবে জীবন যাপন করবে এবং ঈশ্বরের নাম নিয়ে তোমার দিন কাটাবে। ভক্তরা তোমার জন্য যে ব্যবস্থাই করুক না কেন তা ভালবেসেই করবে, কামারপুকুর তোমার নিজের বাড়ি তাকে ধ্বংসহতে দিও না”। তাই নানাবিধ অসুবিধা সত্ত্বেও তাঁর মৃত্যুর পর মা সারদা কামারপুকুরের বাড়িতেই তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন।
রঘুবীরের মন্দির
কামারপুকুরের রঘুবীরের ঘরটি ছিল পূর্বমুখী। খড়ের ছাউনির মেটে ঘর। বর্তমানে রঘুবীরের মন্দিরটি ঐ একই স্থানে তৈরী হয়েছে। এই মন্দিরের রঘুবীরের শালগ্রাম শিলা, মা শীতলার মাটির ঘট, রামেশ্বর শিবলিঙ্গ, নারায়ণ শালগ্রাম শিলা এবং একটি গোপালের চিত্র প্রতিদিন পূজিত হয়।
বৈঠকখানা ও আম গাছ
চট্টোপাধ্যায় গৃহের বৈঠকখানাটি আজও বর্তমান। বৈঠকখানায় পুরানো কাঠের দরজাটি আজও যথাস্থানে আছে। বৈঠকখানার পাশেই রয়েছে ঠাকুরের হাতে লাগানো আম গাছ। সেই গাছে আজও ফল ধরে।
ঠাকুরের জণ্মস্থান
১৮৩৬ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী, বাংলার ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে সূর্যোদয়ের ১২ মিনিট পূর্বে ঠাকুরের আর্বিভাব ঘটে। তাঁর জণ্মের একটু পরেই তাঁর ধাত্রী মাতা ধনী তাঁকে খুঁজে পায়নি, খুঁজতে গিয়ে দেখে শিশুটি পিছলে গিয়ে উনুনের মধ্যে ছাই মাখা অবস্থায় পড়ে আছে কিন্তু কোন কান্না নেই।
যোগীর শিব মন্দির
শ্রী রামকৃষ্ণদেবের ঘরের উত্তর দিকে যোগীর শিব মন্দির। কথিত আছে, একবার এই মন্দিরের সামনে ঠাকুরের মা ধাত্রী মা ধনী ঠাকুরানীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, এমন সময় হঠাৎ শিবের মূর্তি থেকে একটি আলো আর্বিভূত হয় সেই আলোকে গোটা মন্দিরটি আলোকিত হয়ে ওঠে এবং আলোটি দ্রুত তাঁর শরীরে প্রবেশ করে। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন, যখন তাঁর জ্ঞান আসে তখন তিনি অনুভব করেন সেই আলোটি তাঁর গর্ভে তখনও রয়েছে এবং তিনি গর্ভ ধারণ করেছেন। ফলস্বরূপ গদাধরের জণ্ম।
হালদার পুকুর
শিব মন্দিরের উল্টো দিকে বৃহৎ জলাশয়টির নাম হালদার পুকুর। এই পুকুরে গদাধরের ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছ। গদাধর ছেলেবেলায় তাঁর বন্ধুদের নিয়ে এই পুকুরে সাঁতার কাটতে আসতেন।
লাহাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়
লাহাদের দুর্গা মন্দিরের সামনে নাটমন্দিরে স্কুল বসত। গদাধর পাঁচ বছর বয়সে সেখানে ভর্তি হয়। খুব তাড়াতাড়ি লিখতে এবং পড়তে শিখে গিয়েছিল কিন্তু লেখাপড়ায় তার আগ্রহ কমে গিয়েছিল, অন্য এক ভাবের বিকাশ ঘটছিল তার মধ্যে। কোন সময়ে বিশেষ দৃশ্য দেখে অথবা বিশেষ দেবতার চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ত। তার এই অবস্থাকে তার মা অসুখ হয়েছে বলে ভাবতেন এবং তাকে অনেকদিন পর্যন্ত স্কুলে পাঠাতেন না। স্কুলের লেখাপড়া অপেক্ষা গ্রামের নাটকে অংশ গ্রহণ করতে পুরাণ পাঠ করতে বেশী ভালবাসত।
গোপেশ্বর শিবের মন্দির
রামকৃষ্ণের ঘরের পূর্ব দিকে গোপেশ্বর শিবের মন্দির। সুখলাল গোস্বামী অথবা তাঁর ঠাকুরদা গোপীলাল গোস্বামী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একটি বিরাট শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন। একবার রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে ভাবের ঘোরে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর মা খবর পেলেন গদাধর পাগল হয়ে গিয়েছেন, তিনি এই গোপেশ্বরের মন্দিরে কঠিন ব্রত করেন ছেলেকে সুস্থ করে দেওয়ার জন্য।তখন তিনি একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পান যে তাকে একই ভাবে মুকুন্দপুরের শিবের কাছে প্রার্থনা করার নির্দেশ দিচ্ছে, তাঁর এই কঠিন ব্রতর পর তিনি আশ্বাসিত হয়েছিলেন তাঁর পুত্র সুস্থ হয়ে উঠবে।
ধনী কামারানীর মন্দির
রামকৃষ্ণের ঘরের দক্ষিণ পূর্ব দিকে ধনী কামারানীর ঘর। সেই জায়গাতে এখন তাঁর ভক্তরা মন্দির বানিয়েছেন। সেখানে ধনীর কোলে গদাধর এইরূপ তৈলচিত্র করা আছে। ধনী ছিল কামার ঘরের মেয়ে, গদাধরের ধাত্রী মাতা। একবার ধনীকে গদাধর কথা দিয়েছিলেন যে গদাধরের উপনয়নের সময় গদাধর যেন ধনীর কাছ থেকে প্রথম ভিক্ষা গ্রহণ করেন। কিন্তু অব্রাহ্মণেকে ভিক্ষা দান চট্টোপাধ্যায় পরিবারের প্রথা বিরুদ্ধ ছিল। গদাধরের দাদা রামকুমার এর বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু গদাধর এই ব্যাপারে অনড় ছিলেন। অবশেষে গদাধরের পিতার বন্ধু ধর্মদাস লাহা রামকুমারকে বোঝালেন, এতদিন তাদের পরিবারে এরকম হয়নি ঠিকই কিন্তু অনেক ভাল ব্রাহ্মণ পরিবারে অব্রাহ্মণের কাছ থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে তাই এতে কোন দোষ নেই। এইভাবে গদাধর তার ধনীকে ভালোবেসে দেওয়া কথা রেখেছিল।
মুকুন্দপুর শিব মন্দির
শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মস্থানের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে এই মন্দিরটি অবস্থিত। গোপেশ্বরের মন্দিরের আদেশ পেয়ে গদাধরের মা এই মন্দিরে অন্ন, জল ত্যাগ করে শিবের কাছে প্রার্থনা করেন তার ছেলেকে পাগলামির হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। তখন তিনি এই দৈব বাণী শুনতে পান – “ তুমি ভয় পেও না তোমার ছেলে পাগল নয়, সে ঈশ্বরের নেশায় উন্মত্ত তাই সে এরূপ করছে। সেই থেকে ভক্তরা এই মন্দিরে আসেন তাঁদের মনস্কামনা পূর্ন করতে।
বুধুই সমাধিস্থল
কামারপুকুর গ্রামের পূর্ব দিকে শশ্মান। রামকৃষ্ণ যখন কামারপুকুরে থাকতেন তখন বেশিরভাগ সময় কাটাতেন এই শ্মশানে। এখানেই ধ্যানে বসতেন।