১৮৩৬ সালর ১৮ই ফেব্রুয়ারি বুধবার কামারপুকুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়। বেশ কিছুকাল পর ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে এক স্নানযাত্রার দিনে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন রানী রাসমণি। কৈবত্য মহিলার এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে রীতিমত পাহাড় প্রমাণ বাধা পেরোতে হয়েছিল। গদাধরের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রানীর এই প্রথা ভাঙার যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন দক্ষিনেশ্বরের কালীঘরের প্রথম পুজারী। রামকুমারের পর কালীঘরের পৌরহিত্যের গুরুদায়িত্ব বর্তায় আমাদের ঠাকুর গদাধরের উপর। দক্ষিণেশ্বরের দীর্ঘ ত্রিশ বছরের পৌরহিত্য জীবনে গদাধর হয়ে ওঠেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, সকলের আদরের ঠাকুর। এই নবরত্ব মন্দিরটি পরিণত হয় জীবন্ত লীলাক্ষেত্র।
অশিক্ষা এবং কুসংস্কারের প্রভাবে যখন হিন্দু ধর্মত্যাগ এবং খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ কার্যত অলিখিত এক নিয়মবিধিতে পরিণত হয়েছিল, সেইসময় উল্টোপথে হেঁটে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করেছিলেন ঠাকুর ও তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিনেশ্বরের ভক্তি আন্দোলন। রুখে দিয়েছিলেন শিক্ষিত যুবকদের ধর্ম ত্যাগ। ১৮৮৫ সালে ঠাকুর রোগাক্রান্ত হন এবং শেষবারের মত দক্ষিণেশ্বর ত্যাগ করেন। শুরু হয় শেষ যাত্রা। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের দীর্ঘকালব্যাগী বর্ণময় জীবন শেষ হয়ে আসছিল। শুধু দক্ষিণেশ্বরের জীবনই নয় শেষ হয়ে আসছিল ঠাকুরের মনুষ্যজীবন। ১৮৮৫ সালের গ্রীম্মকাল থেকেই ঠাকুর অসুস্থ। তাঁর গলা থেকে প্রথম রক্তক্ষরণ শুরু হয় ১৮৮৫ সালের আগস্টে। ইতিমধ্যেই ঠাকুরের শ্বাশত বাণীর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন বহু শিক্ষিত মানুষ। তাঁদের প্রাণের ঠাকুরের শরীর খারাপের খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন সকলেই। ডাক্তার, কবিরাজ, বৈদ্য কোন কিছুরই তাঁরা অবহেলা করেননি। প্রথমদিকে মনে করা হয়েছিল ঠাকুরের ক্ষীণদেহ এবং কঠিন পরিশ্রমের জন্য কোন অসুখ হয়েছে। ইংরেজীতে যাকে বলে 'ক্লার্জিম্যানস থোট"। সাধারণ মানুষের ভাষায় বলা যায় ধর্মযাজকের গলার ঘা" নামক রোগে ঠাকুর আক্রান্ত। এই অনুমান কিন্তু সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ছিল। ঠাকুরের শরীর ক্রমাগত খারাপ হতে শুরু করে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ঠাকুরের শারীরিক অবনতি চরমে পৌঁছায়। তৎকালীন প্রখ্যাত ডাক্তার হোমিওপ্যাথির বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের ডাক পড়ে।
১৮৮৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তিনি প্রথম ঠাকুরকে দেখেন এবং পরের মাসের ১২ই অক্টোবর থেকে ঠাকুরের নিয়মিত চিকিৎসা শুরু করেন। তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঠাকুরের এই অসুস্থতার কারন হল তদানিন্তন দুরারোগ্য রোগ ক্যান্সার। কবিরাজি ভাষায় যাকে বলা হয়রোহিনী। এইরকম সময় ঠাকুর বাগবাজারের বলরাম বসুর বাড়িতে কয়েক দিন থাকেন। তখনও তাঁর চিরতরে দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যায়নি। ঠাকুরের স্বাস্থ্যের উন্নতির কথা চিন্তা করে তাঁকে চিরতরের মত দক্ষিণেশ্বর থেকে নিয়ে আসেন তাঁর ভক্তরা।
১৮৮৫ সালের ২রা অক্টোবর ঠাকুরকে শ্যামপুকুর অঞ্চলের ৫৫ নম্বর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। শুরু হয় ঠাকুরের জীবনের প্রাক্ শেষ অধ্যায়। এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন ঠাকুর, চিকিৎসকের বাধানিষেধ কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে তিনি মানতেন না। চিকিৎসকগন বার বার তাঁকে সতর্ক করত। আস্তে আস্তে পরিষদরা তৈরি হচ্ছিল। শারীরিক অবস্থার কোনরকম উন্নতি না হওয়ায় কাশিপুর উদ্যানবাটিতে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। রামকৃষ্ণ দেবকে সুস্থ করার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে ভাতৃত্ব বোধ, তৈরি হয় মঠ ও মিশনের প্রথম সোপান। ঠাকুর কল্পতরু অবটারে ধরা দিয়ে ফেলেছেন।
নানা বিধ ঘটনার মধ্যে সময় অতিবাহিত হয়ে শেষলগ্নে উপস্থিত হয় ঠাকুরের জীবন। ঠাকুর চিরতরে চলে যাওয়ার আগে তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় শিষ্যদের এবং মা সারদাদেবীর ভার দিয়ে গিয়েছিলেন নরেনের হাতেই। রবিবার ১৫ই আগস্ট ১৮৮৬ কাশীপুরের শ্রাবণের শেষদিন পরমহংসদেব ভাতেরপায়েস খেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "ভিতরে এত খিদে যে হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি খাই, কিন্তু মহামায়া কিছুই খেতে দিচ্ছেন না।" এই খিচুড়ি খাওয়া নিয়েও এদিন বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। শ্রী মা ভক্ত, শিষ্যদের জন্য যে খিচুড়ি রাঁধছিলেন, তার নীচের দিকটা পুড়ে যায়। বিকেলের দিকে ঠাকুরের শরীরটা খারাপ হওয়ায় শশী ডাক্তার নবীন পালকে নিয়ে আসেন। এদিন রাত্রি নয়টায় ঠাকুরের সমাধি হয়। সমাধি ভঙ্গ হয় রাত প্রায় ১১টায়। তারপর ঠাকুর এক গ্লাস পায়েস পান করে বলেন, "আঃ শান্তি হল"। এখন আর কোন রোগ নেই। এরপর রাত ১টায় ঠাকুর একপাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। তাঁর গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হতে শুরু হয়। স্বামীজি
তাঁর পায়ের উপর লেপ ঢেকে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যান। এই দৃশ্য তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। এরপর ঠাকুরের নাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘরে উপস্থিত শিষ্যরা মনে করেন ঠাকুর সমাধি হয়েছেন। সময়টা ছিল রাত ১টা বেজে ২ মিনিট। ১৬ই আগস্ট ১৮৮৬, সোমবার। সেই রাতেই দক্ষিনেশ্বরে ঠাকুরের ভাইপো রামলালকে খবর দেওয়া হয়। সে এসে ঠাকুরের ব্রহ্মতালু গরম রয়েছে দেখে, ক্যাপ্টেন উপাধ্যায়কে খবর দিতে বলেন। উপাধ্যায় মশায় এসে ঠাকুরের মেরুদণ্ডে তিনঘণ্টারও কিছু বেশি সময় ধরে গব্যঘূত মালিশ করেন। তবুও ঠাকুরের চৈতন্য হয় না।
সকাল ১০টার সময় ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার এসে ঠাকুরের নাড়ি পরীক্ষা করে বলেন তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে। ডঃ সরকারের ভায়েরীর বিবরণ অনুযায়ী ঠাকুরের মৃত্যুর সময় হল ১৮৮৬ সালের ১৬ই আগস্ট রাত্রি ১টা। তাঁর ডায়েরিতে তিনি নোট লেখেন ঠাকুর বাঁপাশ ফিরে শুয়েছিলেন এবং তাঁর চোখ ও মুখের কিছুটা অংশ খোলা ছিল।
এদিন বিকেল পাঁচটায় গৈরিক বসনে আবৃত করে তাঁর দেহ নীচে নামিয়ে একটি খাটের উপর রাখা হয়। সকল ভক্তগন সমবেত হন,ডাক্তারের পরামর্শে একটি ফটো তোলা হয়। এরও একঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ রামকৃষ্ণের নম্বর দেহ নিয়ে তাঁর ভক্তরা রওনা দেয় শেষকৃত্যের উদ্দেশ্যে। কাশীপুর মহাশ্মশানে তাঁর দেহ পুড়ে পঞ্চভূতে মিশে যায়। কিছুটা চিতাভস্ম একটি তামার কৌটোতে সংগ্রহকরে আনেন ভক্তেরা যা আত্মারামের কৌটো নামে পরিচিত এবং আজও বেলুড় এটি রাখা আছে। এইভাবেই শেষ হয় গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের জীবন। কিন্তু তাঁর দর্শন আজও অমলীন। তাঁর মৃত্যুর পর শুরু হয় চরম সংগ্রাম যা ভাষায় ব্যাখ্যা করা কার্যত অসম্ভব। রামকৃষ্ণ নামের প্রতি বিশ্বাসকে পাথেয় করে মঠ ও মিশন একের পর এক প্রতিকূলতাকে জয় করছে।
বহুজন হিতে আজও যেখানে মঠ ও মিশন তার সেবাকর্ম চলায় সেই উপকৃত নরনারায়ণদের মধ্যে পরমহংসদেবের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছো ঈশ্বর,
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।