ভগবান বিষ্ণুর অবতার শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু পাপীদেরকে উদ্ধার করবার জন্য ও হরিনামের মাহাত্ম্য প্রচার করার জন্য ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মহাপ্রভুকে কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী। আসলে সমাজের কাছে গুরুর আদর্শ এবং গুরুদীক্ষার গুরুত্ব প্রমাণ করবার জন্য জগৎগুরুকেও গুরু দীক্ষা নিতে হয়।
শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী ছিলেন সেই গুরু যার কাছে মাথা ঝুঁকিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। কিন্তু শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিলো চৈতন্যদেবের? শিষ্যের অবতারত্বের কথা কি জানতেন শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী? নাকি মহাপ্রভুকে সাধারণ শিষ্য হিসেবেই দেখেছিলেন তিনি? এই সম্পর্কিত বিষয় আজও সাধারণ মানুষের অজানা, আজকের প্রতিবেদনে সেইসব ঘটনাই আপনাদের তুলে ধরব।
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীকে দীক্ষা গুরুরূপে বরণ করেন। ঈশ্বরপুরীর জন্মভূমি ছিল কুমারহট্ট। কুমারহট্ট গ্রামের একজন ধর্মনিষ্ঠ রাঢ়ী ব্রাহ্মণ শ্যামসুন্দর আচার্যের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী। পরমবৈষ্ণব ও সাধু শিরোমণি এই মানুষটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন বৈষ্ণব জগতের সর্বজন মান্য মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের গুরু। ১৪০০ শতাব্দীর মধ্যে ঈশ্বরপুরীর আবির্ভাব ঘটে। প্রথম জীবনে তিনি সংস্কৃত বিদ্যা অর্জন করে অল্প দিনের মধ্যেই সমস্ত রকমের ভক্তি শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করে ফেলেন। তাঁর পাণ্ডিতের কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ঈশ্বরপুরী দীক্ষা লাভ করেছিলেন শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র পুরীর কাছে। গুরুদেবের অভয় চরণে আশ্রয় নিয়ে তিনি তার সেবা কার্যে রত হয়েছিলেন গুরুদেবের শেষ সময় পর্যন্ত।
শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরী গিরিগোবর্ধনে গোপালের সেবায় যখন ব্যস্ত ছিলেন তখন একদিন তার প্রতি গোপালের আদেশ হয় নীলাচল থেকে মলয়জ চন্দন এনে তার গায়ে লেপন করতে হবে তবেই তাঁর শরীরের জ্বালা কমবে। এই আদেশটি মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে এসেছিল গোপালের দ্বারা,তাই গোপালের জ্বালা যন্ত্রণা দূর করবার জন্য গোপালের কথা মেনে নিজেই নীলাচলে গিয়েছিলেন মাধবেন্দ্রপুরী সেই চন্দন আনতে। এরপর মলয়জ চন্দন এনে রেমুনায় শ্রী ক্ষীরচোরা গোপীনাথের স্থানে অবস্থানকালে মাধবেন্দ্রপুরী অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন, শ্রী ঈশ্বরপুরী তখন গুরুদেবের এই অসুস্থতায় তাকে প্রচন্ড পরিমাণে সেবা করেন। শিষ্যের এই নিঃস্বার্থ সেবা ও গুরু ভক্তি দেখে মাধবেন্দ্র পুরী সন্তুষ্ট হন , তিনি তার মধ্যে থাকা সমস্ত কৃষ্ণ প্রেম উজাড় করে দান করে দেন ঈশ্বর পুরীকে।
এই প্রসঙ্গে গ্রন্থে লেখা আছে যে,
"মাধবেন্দ্রপুরী প্রেমময় কলেবর।
প্রেমময় যত সব সঙ্গে অনুচর।।
কৃষ্ণ রস বিনে আর নাহিক আহার।
মাধবেন্দ্রপুরী দেহে কৃষ্ণের বিহার।।
....
...
যত প্রেম মাধবেন্দ্র পুরীর শরীরে
সন্তোষে দিলেন সব ঈশ্বরপুরীরে।।"
এরপর গুরুর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঈশ্বরপুরী তার গুরুর সেবা করেছিলেন, মাধবেন্দ্রপুরী লীলা সংবরণ করলে ঈশ্বরপুরী আহার, নিদ্রা ত্যাগ করেন ও গুরুর শোক সংবরনের জন্য নানা দেশে ঘুরতে থাকেন। এইসময় গয়ায় বিষ্ণুপাদপদ্ম মন্দির গর্ভে উপস্থিত হয়েছিলেন ঈশ্বর পুরী সেখানেই এসেছিলেন নিমাই পন্ডিত। বিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শনে ভাবাবিষ্ট হয়ে উঠেছেন নিমাই, অনিত্য সংসার সমুদ্রকে উপলব্ধি করতে পারছেন ও হয়ে উঠছেন ভাব বিহ্বল, ঈশ্বর পুরী নিমাই পন্ডিতের এই ভাব তন্ময় অবস্থা দেখে তার কাছে এগিয়ে গেলেন। নিমাই পণ্ডিতকে এর আগে ঈশ্বরপুরী নবদ্বীপে দেখেছিলেন তাই তাকে চিনতে পারলেন। অন্যদিকে চৈতন্য মহাপ্রভু ঈশ্বর পুরীকে দেখে বললেন, আমার কি সৌভাগ্য,আজ আমি বিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে পরম বিষ্ণু ভক্তের সাক্ষাৎ পেলাম। আমাকে দয়া করে দীক্ষা দান করে কৃতার্থ করুন।
চৈতন্য মহাপ্রভু ঈশ্বর পুরীকে দেখেই বললেন, 'আপনার পদ্মপদ্ম দেখেই আমার গয়া যাত্রা সফল হয়। এই পবিত্র স্থানে কেউ যদি পিন্ড নিবেদন করে, তবে তার পিতৃপুরুষের মুক্তি হয়। কিন্তু শুধু আপনাকে দেখে কোটি কোটি পিতৃপুরুষ মুক্তি পায়। তাই আপনার উপস্থিতি আরও বেশি পবিত্র। এই পবিত্র তীর্থের চেয়েও মঙ্গলময় সব তীর্থ , আপনার পদ্মের ধূলির জন্য প্রার্থনা করছি,আমাকে কৃপা পূর্বক কৃষ্ণের পদ্মের চরণ থেকে অমৃত পান করান।'
শ্রীপাদ ঈশ্বর পুরী তখন বলেন,'দয়া করে আমার কথা শুনো আমি বুঝতে পেরেছি যে তুমি পরমেশ্বর ভগবানের অবতার। আজ সকালে আমি একটি খুব শুভ স্বপ্ন দেখেছি এবং এখন তা বাস্তবে রূপ পেয়েছে। প্রথম দিন থেকে আমি তোমাকে নবদ্বীপে দেখেছি, আমি সর্বদা তোমার কথাই ভেবেছি। তোমাকে দেখে আমি যতটা আনন্দ পাই, কৃষ্ণকে দেখেও ততটা আনন্দ পাই।' এইকথা শুনে মহাপ্রভু মাথা নীচু করে হেসে উত্তর দিয়ে বলেন,'এটা আমার পরম সৌভাগ্য।'
এরপর ঈশ্বর পুরী দেহ রক্ষা করার পর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এলেন কুমারহট্টে গুরুদেবের জন্মভিটে দর্শন করতে এবং তিনি গুরুদেবের বিচ্ছেদে কাতর হয়ে অবোধ বালকের মতো হা গুরুদেব হা গুরুদেব বলতে বলতে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন ও নিজের কাপড়ে বেঁধে নিলেন গুরুর জন্ম ভিটার মাটি ও মুখে বললেন, " এই ধুলো আমার কাছে আমার জীবনের মতোই প্রিয়।"
প্রভুকে গুরু বাড়ির জন্ম ভিটার মাটি নিতে দেখে লক্ষ লক্ষ ভক্ত পার্ষদ সেখান থেকে মাটি গ্রহণ করতে থাকেন, এইভাবে মাটি নেওয়ার ফলে সৃষ্টি হয় একটি ছোট ডোবা, সেই ডোবা শ্রীচৈতন্য ডোবা নামে পরিচিত। তবে সন্ন্যাস গ্রহণের পর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কুমারহট্টে যেমন এসেছিলেন,তেমনি শ্রীবাস পন্ডিতও শ্রীধাম মায়াপুর থেকে সেখানে গিয়ে বসবাস করেন। তাই কুমারহট্টের মাটি বৈষ্ণব সমাজের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। আজও ভক্ত বৈষ্ণব এখানে এলে এখানকার মাটি মাথায় ঠেকান এবং নিয়ে যান।
তবে শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী বেঁচে থাকাকালীনও কিন্তু মহাপ্রভু তার সেবা করেছেন। দীক্ষাদানের পর একদিন চৈতন্য মহাপ্রভুকে দেখতে ঈশ্বরপুরী এসেছিলেন, মহাপ্রভু তখন গুরুদেবকে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং চৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং নিজে হাতে রান্না করে তাকে যত্ন করে খাবার পরিবেশন করে খাওয়ান। ঈশ্বর পুরী তখন মহাপ্রভুকে বলেন,'তোমার হাত থেকে খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে সক্ষম হওয়া আমার জন্য একটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়।' আসলে ঈশ্বরপুরী তার বক্তব্যের মধ্যে বারংবার প্রকাশ করে দিয়েছেন যে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর শিষ্যের আসল পরিচয়, জগৎ গুরু যে কৃপা করে তাকে গুরু গ্রহণ করেছেন সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আর ভগবানের সেই লীলা সহাস্যবদনে মেনেও নিয়েছিলেন।
অন্যদিকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তিনি নিজের হাতে রান্না করে এবং যত্ন সহকারে গুরুদেবকে খাইয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না, তিনি নিজে তার গুরুদেবের শরীরে চন্দন মাখিয়ে দিয়ে তার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেন- আসলে এইভাবে চৈতন্য মহাপ্রভু সমাজকে শিখিয়ে গিয়েছিলেন যে গুরুর সেবা না করলে ভক্তি বা আধ্যাত্মচেতনায় উন্নতি করা সম্ভব নয়, একজন সাধক যত বড়ই হন না কেন, গুরুর কাছে তাকে মাথা নিচু করে বিনম্র চিত্তে থাকতে হবে ও সবসময় গুরুর সেবা করতে হবে।