চোরের উৎপাতে শিরোনামে এই রাজবাড়ি

এই বাংলায় প্রচুর রাজবাড়ি আছে, আছে তাদের  নানা  ঐতিহ্য,  কিন্তু  আজ  এমন  এক রাজবাড়ির  কথা  বলবো  যা  মূলতঃ  চুরির কারণে একাধিকবার  সংবাদ  শিরোনামে  এসেছে।  কিন্তু   এই  রাজবাড়ি  প্রতিষ্ঠার  পিছনে  আছে  নানা  তথ্য।  আজ  সেই  নিয়েই  কথা  হোক।

বর্ধমানের  দীর্ঘগ্রাম  নামক এক জায়গা থেকে অবিভক্ত মেদিনীপুর (বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুরের) নারায়ণগড়ে এসেছিলেন রাজা গন্ধর্বনারায়ণ পাল। আনুমানিক ৬৭১বঙ্গাব্দে তিনিই নারায়ণগড়ের   হাঁদলায়  এই   রাজবাড়ি  ও  অদূরে  বিষ্ণু মন্দির  নির্মাণ  করেন।  সেই  সময়ই  মন্দিরে  অষ্টধাতুর  ছ’টি  বিগ্রহ  ও  কষ্টি   পাথরের  একটি  শিবলিঙ্গ  স্থাপন করা হয়।  পরে   বিভিন্ন   সময়ে  স্থাপিত  হয়  পিতলের  গোপাল  মূর্তি ও শালগ্রাম  শিলা।  এই   রাজত্বের  শেষ  রাজা  ছিলেন  সতীশচন্দ্র  পাল,   তিনি  আবার  ‘সুলতান’  উপাধিও  পান।  এই  উপাধি  প্রাপ্তির  ব্যাখ্যা  হিসেবে  কথিত  আছে,  যে  এক  সুলতান  রাজা  সতীশচন্দ্র পালের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে তাকে  ‘সুলতান’  উপাধি  প্রদান  করেন  এবং  এক  রাতের মধ্যে  ওই  অঞ্চলে  একটি  মসজিদও প্রতিষ্ঠা  করান,  যা এখনও  বর্তমান।  সেই  সুলতান  একটি  পাঞ্জাও  দেন  রাজাকে,  যার  ফলে  পুরী  যাওয়া   তীর্থযাত্রীদের  ওপর  বিশেষ  কিছু  কর আদায়  করতে  পারার অধিকার  পান  রাজা (প্রসঙ্গতঃ  উল্লেখ্য  ওই  রাস্তা  দিয়ে পুরী  যাওয়া  যেত, এমনকি  শ্রী  চৈতন্যদেবও   সেই  পথেই  পুরী  যান  এবং   সেই  সময়  তিনিও    সতীশ্চন্দ্রের  আতিথ্য  গ্রহণ  করেন )।

 এই নারায়ণগড়ের পাল রাজপরিবারের  প্রায়  ২৬জন  রাজা  ২৭টি  পরগনার   মালিকাধীন  ছিলেন।  দক্ষিণে দাঁতন, পশ্চিমে কেশিয়াডি, উত্তরে  খড়গপুর,  পূর্বে  বালিচক  পর্যন্ত   ছিলো  সেই   বিস্তৃতি।  পরবর্তীকালে  সময়ের  নিরিখেই   রাজ   শাসনের  অবলুপ্তি  ঘটে।

 এই যে চুরির ঘটনা যা বারংবার রাজবাড়িকে  আলোচনার  কেন্দ্রে  এনেছে  সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার  আগে  এই  বাড়ির  অবয়ব  প্রত্যক্ষ  করা  যাক। রাজবাড়ির  প্রবেশ পথের এক্কেবারে  সামনে  আছে  ভগ্নপ্রায় প্রহরীখানা, পরেই রয়েছে  বৈঠকখানা, যেখানে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির  বেশ  কিছু  নথি  এমনকি  রাজার  নিজস্ব নামাঙ্কিত  সীলমোহরের  প্রাপ্তি  ঘটেছে। এছাড়া  কয়েদখানার  হদিশ  মিলেছে  মূল ভবনের  মাটির  নীচে।   এবার মূল ভবনটির  দিকে  এগোলেই  নজর  পড়বে  চারিদিকের  ১২ফুট  উঁচু  পাঁচিল  ও  প্রাচীর  বরাবর সমান্তরালভাবে পরিখা।  এই  রাজবাড়ির   একটা  বিশেষ  বৈশিষ্ট্য  হলো  এখানেই  প্রত্যেকটি  ঘর  একে  ওপরের  সাথে  সংযুক্ত।  একতলার  বিশাল  বাইজি  ঘর  এখন  পার্টিশন  করে  ছোট  করে  দেওয়া হয়েছে।  রক্ষণাবেক্ষনের  জন্যে  অ্যান্টিক   জিনিসগুলোকে  একটি  হলঘরে  রাখা আছে।এবার বলি এই রাজবাড়ির চুরির ইতিহাসের  কথা।   ১২ফুট  উঁচু  পাঁচিল  টপকে  ১৯৮৬সালে প্রথম অষ্টধাতু ও পিতলের সব  বিগ্রহগুলি  চুরি  হয়।  পরে অবশ্য  স্থানীয়  পুকুরে  বস্তাবন্দি  অবস্থায়  সব বিগ্রহগুলিই উদ্ধার হয়।  বছর  পনেরো  আগে  ফের  মন্দিরের  গেট   ভেঙে  বিগ্রহ  চুরির  চেষ্টা  হয়।  তারপরই  বিগ্রহগুলি  সরিয়ে আনা  হয়  রাজবাড়ির  অন্তঃপুরে।  কিন্তু  তাতেও  শেষ  রক্ষা  হয় নি ।  সর্ববৃহৎ  চুরিটি  হয়  ২০১৬ সালে, অন্তঃপুর  থেকে   মোট  ১০টি  মূর্তি  ও   তিনটি  শালগ্রাম শিলা চুরি হয়ে যায়।  মূর্তিগুলির  মধ্যে  ছ’টি অষ্টধাতুর ও  চারটি  পিতলের।  অষ্টধাতুর  মূর্তিগুলি  বেশিরভাগই  রাধা-কৃষ্ণের  যুগল  মূর্তি। যার  ঐতিহাসিক  মূল্য  অসীম ও বাজারগত মূল্য কয়েক কোটি টাকা।  নারায়ণগড়  থানার  অদূরে  এমন  ঘটনায়  প্রশ্নের  মুখে  পুলিশি    নিরাপত্তা।

বর্তমানে রাজবাড়ির পাঁচ শরিকের পরিবার  ওই  বাড়িতে  থাকেন।  শরিকরা মিলে দুর্গাপুজো করেন  বিশাল  করেই।  তবে  এই  রাজবাড়িটির  সাথে  পরিচিতি ঘটেছে সিনেমাপ্রেমীদের, কারণ অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের  সিনেমা  "মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি"  সিনেমাটির  শুটিং  এই বাড়ি  থেকেই  হয়।  যারা  দেখেন নি  তারা  ঘুরে আসতেই পারেন  এই  ঐতিহ্যবাহী  রাজবাড়ি  থেকে,  মন্দ  লাগবে  না।

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...