Jagadguru Shankaracharya: ঘড়া দিয়ে বন্যা আটকে ছিলেন শঙ্করাচার্য!

লোকের মুখে শিশু শঙ্করের প্রশংসা ক্রমশ ছড়াতে লাগল। সন্তানের প্রশংসা শুনে কোন বাবা মা  খুশি হন না? পিতা শিবগুরু আর মাতা বিশিষ্টা দেবীর‌ও তাই আনন্দ ও গর্বের কোন শেষ নেই।

৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে বৈশাখী শুক্লা পঞ্চমীতে জন্ম নিয়েছিল এই ছোট্ট শিশু, নাম শঙ্কর। মাত্র আট বছর বয়সের মধ্যে সে হয়ে উঠল সর্ব শাস্ত্রে পন্ডিত। কেরলের কালাড়ি গ্রামে জন্ম তাঁর। একবার কয়েকজন বিখ্যাত পন্ডিত কালাড়িতে এলেন।  ছেলেটির সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করে মুগ্ধ হয়ে গেলেন সেই পন্ডিতেরা!

কী আশ্চর্য শ্রুতিধর এই বালক! কৌতুহলী হয়ে পন্ডিতেরা শঙ্করের জন্ম কুণ্ডলী দেখতে চাইলেন, জননী বিশিষ্টা দেবী পুত্রের জন্ম পত্রিকা বার করলেন, পিতা আচার্য শিবগুরু ততদিনে ইহলীলা সাঙ্গ করে পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন। পুত্রের এই অসামান্য খ্যাতি তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু শঙ্করের জন্ম কুণ্ডলী দেখে পন্ডিতরা রীতিমতো চমকে উঠলেন! এই বালক যে স্বল্পায়ু ১৬ আর ৩২ বছর বয়সে তার জীবনহানির যোগ রয়েছে। 

বিধবা জননী এই কথা শুনে কেঁদে আকুল হয়ে গেলেন, ছেলে ছাড়া তার আর কেউ নাই! তবে এই কথা শুনে শঙ্করের মনে তখনই জেগে উঠল সংসার ত্যাগের বাসনা। ক্ষণস্থায়ী এই জীবনকে সংসারের মায়ায় আবদ্ধ করে লাভ কি? একদিন প্রত্যুষে শঙ্কর গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন। দুইমাস অবিরাম চলার পর শঙ্কর উপস্থিত হলেন ওঙ্কারনাথ গিরি গুহায়। মহাযোগী গোবিন্দপাদের শরণাপন্ন হলেন তিনি, গুরুর আশ্রয় থেকে তরুণ সাধক তিন বছর কঠোর সাধনা করলেন।

এই সময়ের মধ্যে অসামান্য যোগসিদ্ধি ও তন্ত্র জ্ঞান তার আয়ত্ত্ব হল, সেই সময়ে আশ্চর্য ব্যাপার দেখে আশ্রমের সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। গুরু গোবিন্দ পাদ কয়েকদিন যাবত গুহায় সমাধিতে মগ্ন। আকাশ ভেঙে ক্রমাগত বৃষ্টি হচ্ছে, নর্মদা নদীর কূলে ঝেঁপে দুপাড় ভাসিয়ে দিচ্ছে, প্লাবনের জল ক্রমে গুহার ধারে এসে পৌঁছালো! কিন্তু গুহার ভেতরে ঢুকলে যে গুরুর জীবন বিপন্ন হবে- তাহলে কী হবে উপায়? কী‌ প্রকারে বাঁচানো যাবে গুরুদেবকে? শঙ্কর তখন অকুতোভয় হয়ে বললেন, ভয় নেই আমাদের গুরুদেব পরমব্রহ্ম জ্ঞানী। কোন কিছুতেই তার অনিষ্ট হবে না- এই বলে একটি মাটির ঘড়া এনে কাত করে রেখে দিলেন এদিকে জল কলকল শব্দে গুহার দিকে ছুটে আসতে লাগলো কিন্তু কি আশ্চর্য জল বেগে গুহার দ্বারে এসে ওই মাটির ঘড়ার ভেতর ঢুকে আর কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়! এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে শিশুরা বুঝতে পারলেন, শংকর কোনো সাধারণ মানুষ নন তিনি অবতার পুরুষ। 

কিছুদিন পর গুরুদেব মহাসমাধিতে নিমগ্ন হওয়ার আগে শঙ্করকে বললেন, অদ্বৈত ব্রহ্ম জ্ঞান তোমাকে প্রচার করতে হবে,করতে হবে লুপ্ত তীর্থ গুলির উদ্ধার! মানুষ ঈশ্বর বিমুখ হয়ে পড়েছে,তাদের মনকে জাগাতে হবে। তুমি কাশিতে যাও। গুরুদেবের আদেশে শঙ্কর কাশিতে পৌঁছলেন। গঙ্গার তীরে বসে শুরু করলেন অদ্বৈতবাদ প্রচার। উদার কণ্ঠে ঘোষণা করলেন," ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। এ জগত মিথ্যা। স্বপ্নের মতই অলীক। জীব প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মছাড়া অন্য কিছুই নয়।" 

একদিন মনিকর্ণিকার ঘাটে শঙ্কর স্নান করতে যাচ্ছিলেন, পথে দেখলেন এক অতিকায় চন্ডাল তার সঙ্গে কয়েকটি কুকুর। শঙ্কর বললেন একধারে একটু সরে দাঁড়ান বাবা, কিন্তু চন্ডাল শ্লোক আবৃত্তি করে বলল, আচার্য আপনি কাকে সরে যেতে বলছেন? আমার আত্মাকে না দেহকে? আত্মা সর্বব্যাপী সে সরে যাবে কোথায়? যদি দেহকে বলে থাকেন তবে সে তা পালন করবে কীভাবে? সে তো জড়।

চন্ডালের মুখে এই অদ্ভুত কথা শুনে শঙ্কর স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মুহুর্তের মধ্যেই দেখলেন চন্ডাল নেই, দেবাদিদেব মহাদেব তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন! প্রশান্ত মধুর কন্ঠে তিনি বললেন বৎস সর্বসংস্কারের ঊর্ধ্বে ওঠো , জগতের কল্যাণের জন্য তুমি অদ্বৈত জ্ঞানের প্রচারে অগ্রসর হও, তার আগে উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করো।"

বিশ্বেশ্বরের আদেশ পাওয়ার পর শংকর ঠিক করলেন হিমাচলের কোলে বসে আদিষ্ট গ্রন্থ রচনা করবেন কয়েকজন শীর্ষকে সাথে নিয়ে তিনি রওনা হয়ে গেলেন হৃষিকেশে।সেখানে  গিয়ে তিনি হারানো শ্রী বিষ্ণু বিগ্রহ কে উদ্ধার করলেন।  বদ্রিধামে এসে গভীর জল কুন্ডু থেকে উদ্ধার করেন নারায়ণের প্রাচীন মূর্তি। অবশেষে যান ব্যাস তীর্থে‌। সেখানে চার বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে রচনা করেন, ষোলোখানি শাস্ত্র গ্রন্থের মহাভাষ্য। উত্তরাখণ্ডের দুর্গম তীর্থ গুলি দর্শনের পর সদল বলে তিনি উত্তর কাশিতে পৌঁছোন ও সেখানে অলৌকিকভাবে ব্যাসদেবের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়।

ব্যাসদেব তাকে বলেন অদ্বৈতবাদের ভিতর দিয়ে তুমি শাস্ত্রীয় ভিত্তি রচনা করলেও তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয় নি, দ্বিগবিজয়ী পণ্ডিতদের তোমার সমতে আনতে হবে। ‌

এবার শঙ্কর বেরলেন দ্বিগবিজয়ী পণ্ডিতদের বিজয় অভিযানে। দিকে দিকে তার বিজয় পতাকা উড়তে থাকল, মাত্র ৩২ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি ভারতের চারদিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চারটি ধর্ম দুর্গ- শৃঙ্গেরী, গোবর্ধন, সারদা ও জ্যোতির্মঠ- শঙ্কর, স্বামীজির মতো অবতারগণ তাদের স্বল্পায়ু জীবনে প্রমাণ করেছেন যে আয়ু অল্প হোক কাজ যেন অল্প না হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...