ভ্রাতা লক্ষণের দ্বিতীয় অবতার রামানুজের জীবন

দাক্ষিণাত্যের পার্থসারথীর মন্দিরে গিয়েছেন খ্যাতনামা পন্ডিত কেশবাচার্য, সঙ্গে তার স্ত্রী কান্তিমতীও ছিলেন। ঈশ্বরের কাছে তারা প্রার্থনা জানালেন,"আমাদের সন্তান দাও প্রভু। সন্তানের অভাবে আমাদের সংসার নিরানন্দময়।"

ভগবান পার্থসারথীর কাছে তাদের প্রার্থনা পূর্ণ হলো। ১০১৭ খ্রিস্টাব্দে কেশব আচার্যের ঘর আলো করে এক দিব্য কান্তি শিশুর জন্ম হলো। এই শিশুই  পরবর্তীকালে ভারত বিখ্যাত পুরুষ আচার্য রামানুজ হয়ে ওঠেন। ছোট থেকেই রামানুজ অত্যন্ত কৃষ্ণ ভক্ত ছিলেন। শাস্ত্র অধ্যয়নের প্রতি তার প্রবল অনুরাগ ছিলো, পিতার কাছে সে বহুদিন শাস্ত্র পাঠ করে। এক সন্ধ্যাতে সে একজন সাধুকে আমন্ত্রণ করে বাড়িতে নিয়ে এলো, অতিথি সৎকার করবে বলে। কিন্তু ছোট রামানুজের দিব্যকান্তি চেহারা দেখে সাধু তার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না, রামানন্দ জানালো, সে সাধুর পদ সেবা করতে চায়। সাধু বললেন, তিনি শুদ্র, ব্রাহ্মণ সন্তানের হাতে পদসেবা কী করে নেবেন? রামানুজ তখন উত্তর দিলো,"পৈতে নিলেই কি ব্রাহ্মণ হয়? বিষ্ণু কে যে ভক্তি করে সেই প্রকৃত ব্রাহ্মণ। "

বালকের মুখে এই উক্তি শুনে সাধু পুরুষটি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ইনি সাধক প্রবর কাঞ্চীপূর্ণ। তার শুধু এক রাত্রের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করে রামানুজের জীবন পরিবর্তিত হয়ে গেলো। পিতার মৃত্যুর পর রামানুজ কাঞ্চীর বিখ্যাত অদ্বৈতবাদী আচার্য যাদব প্রকাশের কাছে গেলেন, শাস্ত্র বিষয়ে আর‌ও অভিজ্ঞতা লাভের জন্য। কিছুকালের মধ্যেই বোঝা গেলো রামানুজ শুধু মেধাবী নন, শাস্ত্রে তার যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি আছে। একদিন ছান্দোগ্য উপনিষদের একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা নিয়ে সমস্যা তৈরি হলো, সবাই যখন একটি শ্লোকের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছিলো তখন গুরুর কাছে সেই শ্লোকের সম্পূর্ণ একটি অন্য ব্যাখ্যা দিলেন- অসামান্য মেধা দেখে গুরু যেমন চমৎকার হলেন তেমনি ঈর্ষান্বিত হলেন,তিনি ভয় পেলেন যে, বালক অল্প বয়সে এই অদ্ভুত মেধা লাভ করেছে তার প্রতিভার ছটায় যদি যাদব প্রকাশের খ্যাতি ম্লান হয়ে যায়! এই আশঙ্কা থেকেই তিনি আশ্রম থেকে তাড়িয়ে দিলেন শিষ্যকে, এখানেই শেষ নয়,গোপনে তাকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করলেন গুরুদেব কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো তার।

Ramanujacharya

রামানুজের জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, শ্রীরঙ্গমের প্রসিদ্ধ ভক্ত সাধক শ্রীরঙ্গনাথের পূজারী যমুনাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ। যমুনাচার্য রামানুজকে দেখেই বুঝতে পেরে ছিলেন যে, এই তরুণ সাধক ছাই চাপা আগুন। যামুনাচার্য তার জীবনের শেষ অবস্থায় তিনি রামানুজকে শ্রীরঙ্গমে আসার জন্য আহ্বান করেন কিন্তু রামানুজ সেখানে গিয়ে যখন পৌঁছান, ততক্ষণে শ্রীরঙ্গম দেহ রক্ষা করেছেন। রামানুজ সেখানে গিয়ে যামুনাচার্যের মরদেহের কাছে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেন যে, বৈষ্ণব ধর্মে দৃঢ়নিষ্ঠ থেকে অজ্ঞান মোহিত জনগণকে আমি সংস্কার মুক্ত করবো।রামানুজ এরপর বেদান্ত ভাষ্য, গীতা ভাষ্য প্রভৃতি রচনার দিকে মন দেন। শংকরাচার্যের মতবাদ খন্ডন করে তিনি অদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। প্রচুর ভক্ত তার অনুগামী হয়। এই সময় ত্রিশিরাপল্লীর রাজা রামানুজের কার্যকলাপে ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। তিনি ভাবেন যে, এই নবীন সাধক মানুষকে উত্তেজিত করে পূর্বের ধর্মমত পাল্টে দিচ্ছেন। এমন ধারণা রাজার মনে বদ্ধমূল হয়ে ওঠে আর তিনি রামানন্দকে হত্যা করবার জন্য লোক নিযুক্ত করেন। রামানুজ তখন আত্মরক্ষা করবার জন্য মহীশূরের অন্তর্গত মেলকোটে চলে যান।  সেখানকার অধিপতি বল্লালরাজ ছিলেন জৈন ধর্মালম্বী পরম সাধু ভক্ত। রামানুজের দৈব এখানে তার সহায় হলো।

সেই সময় বল্লাল রাজের মেয়ের ওপর ব্রহ্মদৈত্য ভর করে। রাজকন্যা ঘর ছেড়ে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াতে থাকে। দেশ দেশান্তর থেকে অনেক  ব্রাহ্মণ, গুণী,বৈদ্য,কবিরাজ প্রভৃতি এসে নানান রকম প্রক্রিয়া ও দৈব কার্য করলেও কেউই তাকে সুস্থ করতে পারেন নি। রাজা অবশেষে কন্যার ভালো হ‌ওয়ার আশা পরিত্যাগ করেন। এই সংবাদ শুনে রামানুজ রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন,"আমি একবার আপনার কন্যাকে দেখতে চাই।" রাজকন্যাকে তার সামনে আনা হলে রামানুজ কন্যার দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন। কি অদ্ভুত! কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রহ্মদৈত্য রাজকন্যার শরীর ছেড়ে চলে গেলো এবং ধীরে ধীরে কন্যা সুস্থ হয়ে উঠল এই ঘটনার পরে  রামানুজের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হলেন রাজা এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর বল্লালরাজের নাম হল বিষ্ণু বর্ধন। তবে রামানুজের ধর্ম গ্রহণ করবার পর স্বাভাবিক ভাবেই জৈন ধর্মালম্বীরা রাজার উপর ভয়ঙ্কর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। রাজা তখন নিরুপায় হয়ে রামানুজের শরণাপন্ন হলেন। রামানুজ বললেন, জৈন গুরু ও পণ্ডিতদের ডাকুন। তারা যদি তর্কে আমাকে হারাতে পারেন, তবেই আমি তাদের মতবাদ মেনে নেব। অবিলম্বে জৈন গুরু ও পন্ডিতদের ডাকা হলো, একের পর এক সকলেই রামানুজের নিকট যুক্তি তর্কে পরাস্ত হলেন, অনেকে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন, কেউ বা অপমানিত বোধ করে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন।

ভক্ত ও সন্ন্যাসীরা বিনা দ্বিধায় তাকে সমাধীশ নিযুক্ত করেন। কথিত আছে, শ্রী রঙ্গনাথ রামানুজের প্রতি প্রসন্ন হয়ে স্বপ্ন যোগে  দুটি বিশেষ বিভূতির অধিকার দান করেন তাকে। ‌ একটি মানুষের সন্তাপ নিবারণের ক্ষমতা আর অপরটি হলো ভক্ত প্রতিপালনের উপযুক্ত ঐশী শক্তি। শেষ জীবনে রামানুজ শ্রীরঙ্গমে বাস করতেন। তার ওপরেই রঙ্গনাথ দেবের সেবার ভার দেওয়া হয়েছিল। বহু ভক্তের দৃষ্টিতে তিনি প্রতিভাত হয়েছিলেন শ্রী রামচন্দ্রের ছোটো ভাই লক্ষণের দ্বিতীয় অবতার রূপে। ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে মাঘী শুক্লা দশমীতে এই মহাপুরুষ নির্মাণ লাভ করেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...