বিকাল হলেই গলির মধ্যে টং-টং।
না, এ কোনও ঘড়ির শব্দ নয়। তবু এই আওয়াজেই বাড়ির ঘড়িখানা মিলিয়ে নেন কেউ কেউ। জানলা, বারান্দায় উঁকি-ঝুঁকি। চুলের মতো সরু গলি দিয়েও দিব্যি হেঁটে যায় এক ট্রলি। ট্রলিতে জ্বলন্ত স্টোভ, ঝোলনা আর কলাপাতার রাশি।
পাড়া পাড়ায় বিকেলের চেনা স্ন্যাকস জংশন এখন এই ট্রলিগুলোই। ইডলি-দোসা-সম্বর আর চাটনির সম্ভার। কলকাতা আর শহরতলির বিকেলে চোখ রাখলেই নজরে আসবে এই দৃশ্য।
ভিড় ঘেরা ট্রলি স্টলে ব্যস্ত হাতে কলাপাতায় মোড়া ইটলি দোসা চালান হয়ে যাচ্ছে হাতে হাতে। এখন অনেকের কাছেই বিকেল মানে নারকেলের চাটনি আর সম্বরের স্বাদ। অথচ এক সময় নারকেল তেল বা চাটনির একেবারেই না পসন্দ ছিল বাঙালি খাদ্য রসিকদের। এখন কিন্তু সে ছবি আমূল বদলে গিয়েছে।
উত্তর থেকে দক্ষিণ, টালা থেকে টালিগঞ্জ যে দিকেই তাকানো যাক না কেন শহরে রমরমিয়ে উপস্থিত দক্ষিণী খাবারের স্টল আর রেস্তোরাঁ। দক্ষিণী স্বাদ কে আপন করে নিয়েছে বাঙালি। এক সময় যা ছিল নেহাদ পথ চলতি অন্য স্বাদের এডভেঞ্চার এখন তাই পরিণত হয়েছে পাকাপাকি প্রেমে।
দক্ষিণী খাদ্য সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বহু। তবে কেরালা, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশের অমিলের মধ্যেও মিল অনেক।
দক্ষিণী রাজ্যের মন্দিরগাত্র এবং পুরনো পুঁথি,কাব্যতে খাবার নিয়ে শ্লোকও পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের মূল বুনিয়াদ হল চাল। পদ যাই হোক না কেন, চালের ব্যবহার থাকবেই। ভাত নিয়ে সেখানে যে বৈচিত্র্য তা আর কোনও প্রদেশে নেই। দই ভাত, লেবু ভাত, পোঙ্গল ভাত, সম্বর ভাত তো আছেই দোসা এবং উত্তাপমের ‘বেস’ ও তৈরি হয় চাল দিয়েই। ভেজা চালকে বেটে।
খাবার পরিবেশন করা হয় কলাপাতায়। যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান, জমায়েত, বিশেষ বিশেষ উৎসবে কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করা হয়। কলাপাতা হতে হবে আংট কলাপাতা। এক পাতার মধ্যেই তরিতরকারি থেকে শুরু করে চাটনি মিষ্টি সব ধরনের ব্যঞ্জন সাজিয়ে দেওয়া হয়।
একটা ধারণা আছে দক্ষিণী খাবার মানেই নিরামিষ, তা কিন্তু নয়। দক্ষিণী খাবারের তালিকায় মাছ, মাংস সবই পড়ে। বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ‘মাটন’, ‘চিকেন’ এমনকি বিফও রান্না করা হয় দক্ষিণী হেঁশেলে। বিভিন্ন রকম দক্ষিণী কারী হয় খাসির। রান্নার পদ্ধতি বাকি ভারতের থেকে আলাদা। রান্নায় মশলা ব্যবহারে পার্থক্য তো আছেই। সর্ষে, কারিপাতা, জিরে, ধনে, লঙ্কা, হলুদ নারকেল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া নানারকম শুকনো ফল, আচার, তেঁতুল ব্যবহার হয় রান্নায়। রান্নার পদ অনুযায়ী সবজি কাটায় বদল হয়। নারকেল তেল এবং নারকেল দুধ দক্ষিণী রান্নার ‘সিগনেচার’ ।
‘ইনস্ট্যান্ট’ ইডলি, দোসা, বড় মিস্ক্ড ব্যবহার করলেও প্যাকেট মশলা কিন্তু এখনও দক্ষিণী রান্নাঘরে আধিপত্য দেখাতে পারেনি।
এক একরকম রান্নার জন্য একবেক রকম হাঁড়ি। তাদের আকার আয়তন সবটাই আলাদা। মাটির পাতিলে মাছের পদ রান্না করলে স্বাদের পার্থক্য চোখে পড়ার মতো।
দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ ভারতের খাদ্য সংস্কৃতিতে ভীষন ভাবে প্রভাবিত।
দক্ষিণী খাবারে স্বাস্থ্য এর দিকটা সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। সমুদ্রের নোনা ভাব, খর রোদ থেকে বাঁচতে টকের ব্যবহার মুখ্য।
চলতি সময়ের সঙ্গে দক্ষিণী খাবারের সংস্কৃতিতে বদল এলেও মূল জায়গায় কিন্তু আজও একই আছে। সামুদ্রিক আবহাওয়ার কারণেই।