দেবী সতীর ৫১ পীঠের ত্রয়োদশ বা তেরোতম সতীপীঠ হল মা মঙ্গলচণ্ডী মন্দির, উজানি সতীপীঠ, কোগ্রাম, পূর্ববর্ধমান। রাঢ় বাংলার অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রাচীন শক্তিপীঠ এটি। এই সতীপীঠে প্রচারের আলো পড়েছে খুব কম। অল্প মানুষই হয়তো এই পীঠের কথা জানেন।
বর্ধমান থেকে গুসকরা রোডে যেতে ডানদিকে কিছুদূর গিয়ে মাটির আলপথ ধরে এগোলেই দেবী মঙ্গলচণ্ডিকার মন্দির।পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে দক্ষযজ্ঞের পর ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা খণ্ডিত দেবী সতীর শরীরের বাম কনুই পড়েছিল বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের কাছে উজানী নামক স্থানে। বর্তমানে এই জায়গাটি কোগ্রাম নামে পরিচিত। দেবী এখানে মঙ্গলচণ্ডী নামে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে অধিষ্ঠিতা। ঐ গ্ৰন্থে উল্লিখিত উজ্জয়িনীই বর্ধমান জেলার "উজানি" সতীপীঠ।
"উজ্জয়িন্যাং কর্পূরঞ্চ মাঙ্গল্যঃ কপিলাম্বরঃ।
ভৈরবঃ সিদ্ধিদঃ সাক্ষাদ্দেবী মঙ্গলচণ্ডিকা।।"
আবার ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যেও রয়েছে —
"উজানীতে কফোণি মঙ্গলচণ্ডী দেবী।
ভৈরব কপিলাম্বর শুভ যারে সেবি।।"
এখানে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম মঙ্গলচণ্ডী ভৈরব কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর। গ্রাম্য পরিবেশ বেষ্টিত এই পীঠের পিছনে বয়ে চলেছে অজয় নদ। দক্ষিণ দিক থেকে বয়ে আসা কুনুর নদী অজয়ের সঙ্গে মিশেছে পীঠের অদূরে। মঙ্গলকাব্যে এই স্থানটি ভ্রমরারদহ নামে পরিচিত। এই অঞ্চল থেকে বহু প্রত্নসম্পদ পাওয়া গিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই উজানি কোগ্রামে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি প্রাচীন একটি শান্তিনাথের জৈনবিগ্রহ উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই স্থানটি একসময় শৈব, শাক্ত, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের মিলনস্থল হয়ে উঠেছিল।
উজানি নগর হল চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের নায়ক শ্রীমন্ত সওদাগর-এর জন্মস্থান। আবার মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলার বাপের বাড়ি অর্থাৎ বেহুলার পিতা সায়বেনের বাড়িও ছিল উজানিতে। "কবিকঙ্কণ" মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত চণ্ডীমঙ্গলে এই দেবীর মাহাত্ম্য রচিত হয়েছে। চণ্ডীমঙ্গল দুটি ভাগে বিভক্ত- আখেটিক খণ্ড ও বণিক খণ্ড। বৃহদ্ধর্মপু্রাণের একটি শ্লোকেও এই দুটি কাহিনীরই ইঙ্গিত রয়েছে। আখেটিক খণ্ডের অন্তর্গত কালকেতু-ফুল্লরা আখ্যানে দেবী দ্বিভুজা, তার প্রতীক মঙ্গলঘট, পূজার উপচার মাঙ্গল্য ধানদূর্বা।
অন্যদিকে বণিকখণ্ডের উপাখ্যান অনুযায়ী– বণিক শ্রীপতি সদাগর ছিলেন পরম শৈব। তাই তিনি দেবী মঙ্গলচণ্ডীর পূজা করতে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে ইন্দ্রের রাজসভার নর্তকী রত্নমালা দেবরাজ কর্তৃক শাপগ্রস্ত হয়ে মর্ত্যে শ্রীপতি সদাগরের প্রথম পত্নী লহনার খুড়তুত বোন খুল্লনারূপে জন্ম নেন। খুল্লনার সঙ্গে শ্রীপতির দ্বিতীয় বিবাহ হয়। বিবাহের পর প্রথম পত্নী লহনা তাঁর দাসী দুবলার কুপরামর্শে খুল্লনাকে প্রতিদিন ছাগল চড়াতে যেতে বাধ্য করেন। খুল্লনা তখন দেবী মঙ্গলচণ্ডিকার আরাধনা করে। তার পূজায় দেবী প্রসন্ন হন ও তাকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
শ্রীপতি সওদাগর সিংহলের উদ্দেশে বাণিজ্যযাত্রায় রওনা হন। খুল্লনা তাকে মা চণ্ডীর আরাধনা করতে বললে তিনি অস্বীকার করেন এবং মা মঙ্গলচণ্ডীর ঘটে পদাঘাত করেন। রুষ্ট দেবী তাঁকে শাস্তি দেওয়ার মানসে সিংহলের বন্দরের কাছাকাছিই হস্তীভক্ষণ ও উগলরত (হাতি গিলে নিয়ে আবার মুখ থেকে বের করে দেওয়া) ষোড়শী কমলেকামিনী রূপ দর্শন করান। কিন্তু দেবীর মায়ায় অন্য কোন নাবিক কিন্তু এই দৃশ্য দেখতে পায় না।
এরপর সিংহলে উপস্থিত হয়ে সিংহলরাজের নিকট তিনি কমলেকামিনীর বর্ণনা করলে, রাজা তাকে অনুরোধ জানান রাজাকেও দেবীর সেই রূপ দর্শন করানোর জন্য। শ্রীপতি রাজাকে কমলেকামিনী দর্শন করাতে ব্যর্থ হলে রাজা তাকে কারারুদ্ধ করলেন।এদিকে পিতার সন্ধানে শ্রীপতি-পুত্র শ্রীমন্ত সিংহলের উদ্দেশে যাত্রা করেন। দেবীর মায়ায় তিনিও কমলেকামিনী রূপদর্শন করেন এবং সিংহলের রাজার কাছে বর্ণনা করে সেই রকম বিপদে পড়েন।
এবার ক্রোধান্বিত রাজা তাঁকে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। বন্দী হয়ে কারাগারে তিনি দেবী চণ্ডীর বন্দনা করতে লাগলেন। তুষ্ট দেবীর কৃপায় রাজা শ্রীমন্তকে মুক্তি দিয়ে কন্যা সুশীলার সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেন। পুত্র শ্রীমন্তর প্রয়াসে সিংহলের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শ্রীপতি সওদাগর দেবীর মহিমা স্বীকার করতে বাধ্য হন। এরপর তিনি উজানি ফিরে এসে দেবী মঙ্গলচণ্ডীর মন্দির তৈরি করেন। এইভাবে দেবীর পূজা মর্ত্যে প্রচারিত হয়।
এখানে দেবী মঙ্গলচণ্ডী মহিষমর্দ্দিনী ও ভৈরব কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর। এখানে দুর্গাপূজা, কালীপুজো সবই হয়, তবে কোনও আলাদা মূর্তিতে নয়, দেবীর যে কষ্টিপাথরের মূর্তি আছে সেই মূর্তিতেই। এটি সতীপীঠ হওয়ার কারণে দুর্গাপুজোয় আলাদা করে মূর্তি আসে না এবং নবপত্রিকা আনা হয় না। শুধু নতুন ঘট আনা হয়। বছরে তিনবার এই ঘট বদল হয়। প্রথম ঘট আসে বৈশাখের শেষ মঙ্গলবার এবং সেই সময় বাৎসরিক পুজো হয়।
এরপর ঘট আসে জিতাষ্টমীর পরদিন, যাকে বোধনের ঘট বলা হয়। তারপর ঘট আসে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন। এছাড়াও বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবারে মঙ্গলচণ্ডীর পুজো হয়। এখানে বলিপ্রথা চালু আছে। দুর্গাপুজোর সপ্তমী এবং অষ্টমীতে চালকুমড়ো, নবমীতে চালকুমড়ো, কলা, আখ এবং ছাগ বলি হয় সারাবছর দেবীর অন্ন, ভাজা, ডাল, পায়েস, মাছ ইত্যাদি সহকারে ভোগ হয়। কেবলমাত্র দুর্গাষ্টমীর দিন দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়।
মা এখানে দশভূজা দুর্গা। আগে মায়ের বিগ্রহ ছিল অষ্টধাতু নির্মিত। কিন্তু সেটি চুরি হয়ে যায়। এরপর কিছুদিনের জন্য ছবিতে মায়ের পুজোপাঠ চলত। পরে ১৯৯৪ সালে কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের পরিবারের সদস্যরা বর্তমানের কষ্টিপাথরের বিগ্রহ গড়ে দেন। উল্লেখ্য, এই কোগ্ৰাম কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের জন্মস্থান। বর্তমানে রায় পদবির ব্রাহ্মণরা এই মন্দিরের সেবায়েত। মন্দিরেই রয়েছে মায়ের ব্রহ্মশীলা। দেবীর ভৈরব কপিলাম্বর দেবীর পাশেই বিরাজমান। ভৈরবের পাশে রয়েছে একটি বজ্রাসন বৌদ্ধমূর্তি। ইতিহাসবিদদের ধারণা এই মূর্তিটি পাল সাম্রাজ্যের সময়ের।মন্দিরের পাশেই রয়েছে নাটমন্দির। সুন্দর বাগানসহ নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে মন্দিরকে। গ্রামের একবারে শেষ প্রান্তে নিরিবিলি নদীর ধারে মন্দির হওয়ায় এই মন্দিরের পরিবেশ ভারী শান্তিময়।
গ্রামের জনবসতি খুব বেশি নয়। দিনের শেষে যখন অজয়ের বাঁকে সন্ধ্যা নেমে আসে, দেবীর সন্ধ্যারতির কাঁসর বেজে ওঠে। শঙ্খ, ঘন্টার আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে অজয় নদের দুই তীর। মা মঙ্গলচণ্ডী মঙ্গলময়ী রূপে প্রতিনিয়ত তার সন্তানদের রক্ষা করে চলেছেন এই দেবীপীঠ উজানিতে।