পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহরের কাছে অবস্থিত একটি ছোট মন্দির-শহর। এই শহরকে মনে করা হয় মহাপীঠ। হিন্দু ভক্তজনের কাছে এই স্থান মহাপুণ্যভূমি। যুগ যুগ ধরে এই মত প্রচলিত যে এই পুণ্যস্থানে পুজো দিলে কোনো ভক্তের মনের বাসনা অপূর্ণ থাকে না। এখানে যোগীরা সাধনা করলে তারা সর্বসিদ্ধি লাভ করে থাকেন। এখানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে অসংখ্য সাধক সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন। বলা হয় এখানে মায়ের পুজো দিলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। এই পুণ্যস্থান হল বামাক্ষ্যাপার স্মৃতিবিজড়িত মহাপীঠ তারাপীঠ। প্রচলিত মত - তারাপীঠ একটি সতীপীঠ। এখানে দেবী সতীর চোখের তারা পতিত হয়েছিল। এখানে দেবী 'উগ্ৰতারা' রূপে পূজিতা হন। এই পীঠের পীঠরক্ষক ভৈরব হলেন চন্দ্রচূড় শিব। ভক্তিই এখানে শেষ কথা।
'তারাপীঠং মহাপীঠং গন্তব্যং যত্নতঃ সদা।'
এই পীঠ একান্ন পীঠের একটি কিনা সে বিষয়ে মতান্তর থাকলেও তারাপীঠ যে যোগী মহাযোগীদের সাধনপীঠ, একটি "সিদ্ধপীঠ", অর্থাৎ এখানে সাধনা করলে সাধকের জ্ঞান, আনন্দ ও সিদ্ধি প্রাপ্তি হয় তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যোগীশ্রেষ্ঠ বামাক্ষ্যাপা এই তারাপীঠে মা তারার সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। প্রচলিত কিংবদন্তী, সাধক বশিষ্ঠ এখানে দ্বারকা নদীর তীরে মহাশ্মশানের শ্বেত শিমূল গাছের নিচে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তারামায়ের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন।
তারাপীঠ বহু প্রাচীন ধাম। কথিত, পাল যুগে জয়দত্ত নামের এক সওদাগর স্বপ্নাদেশ পেয়ে শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে দেবীর শিলা মূর্তি উদ্ধার করে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। জনশ্রুতি, দেবী তারার কৃপায় তার মৃত পুত্র প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। জয়দত্তের পর নাটোরের রানী ফের মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। ১২২৫ বঙ্গাব্দ, (ইংরেজি ১৮১৮ সালে) বর্তমানের আটচালা মন্দিরটি তৈরি করান মল্লারপুরের জমিদার জগন্নাথ রায়। এই মন্দিরটি উত্তরমুখী। মহাপীঠ বলে পরিচিত এই মন্দির, হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ধর্মস্থান। মন্দিরের প্রবেশপথে খিলানের ওপর দুর্গার প্রতিকৃতি রয়েছে। উত্তরদিকে বাঁ দিকের খিলানের ওপর মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঘটনা, ভীষ্মের শরশয্যা, প্রভৃতি কাহিনী খোদিত রয়েছে। মন্দিরের উত্তরের ভিতের পূর্বদিকে সীতাহরণ, অকালবোধন, রাম ও রাবণের যুদ্ধের দৃশ্য ইত্যাদি রামায়নের কাহিনী এবং পশ্চিমদিকে কৃষ্ণলীলার চিত্র উৎকীর্ণ রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীমূর্তি স্থাপিত। বহুল প্রচলিত কিংবদন্তী কাহিনী অনুযায়ী সমুদ্রমন্থনের সময়, বিষপান করে নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন মহাদেব৷ বিষের জ্বালায় জর্জরিত তিনি। সেই যন্ত্রণা থেকে কীভাবে তিনি মুক্তি পাবেন! সব দেবতা 'দেবী তারার' কাছে গিয়ে বললেন, শিবকে বিষমুক্ত করতে। তীব্র হলাহল পানের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে দেবী তারা তাঁকে স্তন্যপান করিয়ে বিষমুক্ত করেছিলেন৷ সেই অমৃত সুধায় মহাদেবের জ্বালা দূর হল। সেই থেকে দেবীর নাম হল তারিণী। তিনি শিবকে ত্রাণ করেছিলেন তাই তিনি তারিণী। এই মহাবিশ্বকেও তিনিই ত্রাণ করেন। এই তারিণী থেকেই তারা নামের সৃষ্টি। এখানে দেবী দ্বিভুজা, সর্পময়যজ্ঞ উপবীত ধারণ করে আছেন, তাঁর কোলে স্তন পানরত স্বয়ং মহাদেব পুত্ররূপে অবস্থান করছেন। মায়ের শিলারূপ ঢাকা থাকে একটি রূপার আচ্ছাদনে। সেই আচ্ছাদনকেই তারা মায়ের রূপের প্রতীক ধরা হয়। মূর্তির মাথার উপরে রয়েছে একটি রূপোর ছাতা। প্রতিকৃতি বিগ্রহের নিচে গোলাকার একটি বেদীতে দুটি রূপোর পাদপদ্ম থাকে। দেবীর এই মূর্তিই দেবী তারার মূর্তি রূপে ভক্তদের কাছে পূজিতা। কিংবদন্তী, একবার দেবীর মাতৃরূপ দর্শন চান বশিষ্ঠ মুনি৷ মাতৃরূপে তাঁকে দর্শন দেন দেবী।
তারাপীঠ মহাশ্মশানে দূর দূরান্ত থেকে আসেন তন্ত্রসাধকরা। হিন্দু তন্ত্রমতে, কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতে তারাপীঠে কঠোর তপস্যা করলে আশাতীত ফল পাওয়া যায়। সাধক কুলকুণ্ডলিনী চক্র পর্যন্ত জয় করতে পারেন। তন্ত্র মতে কৌশিকী অমাবস্যার রাতকে 'তারা রাত্রি'ও বলা হয়৷ এই তিথিতে নাকি এক বিশেষ মুহূর্তে স্বর্গ ও নরক দুইয়ের দরজা কয়েক লহমার জন্য খোলে। তখন তন্ত্রসাধক নিজের ইচ্ছা মতো ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক শক্তি সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধি লাভ করতে পারেন৷
তারাপীঠে মাকালীকে শুধুমাত্র তারা রূপে নয়, রাজরাজেশ্বরী, একজটা বা নীল সরস্বতী রূপেও পুজো করা হয় । প্রতি শনিবার এবং মঙ্গলবার মা তারার মন্দিরে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয় দেবী দর্শনের জন্য। তারাপীঠ শুধু এই রাজ্য বা দেশ নয়, সারা পৃথিবীর অত্যন্ত জনপ্রিয় সাধন ক্ষেত্র। মহাপীঠ রূপে পরিচিত এই মন্দির, এই স্থান হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ধর্মস্থান। বলা হয়, মানুষ যদি সৎ হয়, তবে পৃথিবীর যে প্রান্তেই সে থাকুক এবং যে ধর্ম অবলম্বন করুক না কেন, মা তারা সর্বদা তাকে আর্শীবাদ করবেন, সঙ্গে থাকবেন এবং মনোকামনা পূরণে সহায়তা করবেন।