বঙ্গভূমির শক্তিপীঠঃ মা নলাটেশ্বরী মন্দির

"পীঠ" কথাটির অভিধানগত অর্থ 'উচ্চ আসন' যেখানে দেবতা বিশেষভাবে বিরাজিত। সতীপীঠ অর্থ সেই বেদী বা আসন বা দেবালয় যেখানে বিরাজ করছেন দেবী সতী। আজ আমরা যে সতীপীঠে যাব সেই পুণ্য দেবীমন্দির বা সতীপীঠটি বীরভূম জেলায় অবস্থিত যে বীরভূম জেলায় রয়েছে পাঁচ পাঁচটি সতীপীঠ। বীরভূম জেলা বহু প্রাচীন যুগ থেকেই তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের পীঠভূমি। পাঁচটি সতীপীঠ ধারণ করে রাখা বীরভূমে শক্তির আরাধনা হয় সারা জেলাতেই।

প্রচলিত জনশ্রুতি, মা কালী নাকি স্বয়ং অধিষ্ঠান করেন বাংলার এই রাঙামাটি অঞ্চলে। ভারতবর্ষের কোন রাজ্যের, জেলার বা শহরের এমন ঐতিহ্য নেই। সতীর ৫১ পীঠের ইতিহাস সম্পর্কে সকল হিন্দু ধর্মের মানুষই জ্ঞাত আছেন। তবুও আরেকবার সেই তথ্য জানানো যাক। দক্ষের যজ্ঞে স্বামী মহেশ্বর মহাদেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞাগ্নিতে আত্মাহুতি দেন দক্ষকন্যা দেবী সতী।

এরপর সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন মহাদেব। মহাদেবকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহ একান্ন খণ্ডে বিভক্ত করে দেন স্বয়ং নারায়ণ। ভারত সহ পৃথিবীর আরো কয়েকটি দেশের মোট একান্ন স্থানে সতীর দেহ খণ্ডগুলি পতিত হয়েছিল। এবং পৃথিবীতে পড়া মাত্র সেই দেহাংশগুলি প্রস্তরখণ্ডে পরিনত হয়েছিল। এই দেহাবশেষ যেখানে যেখানে পড়েছিল সেই স্থানগুলোই এক একটি সতীপীঠরূপে পরিচিতি লাভ করেছে।

আমাদের আজকের পর্ব মা নলাটেশ্বরীকে নিয়ে। বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে, ঝাড়খণ্ড সীমানার কাছে নলহাটি শহর। একসময়ে এই জায়গাতে মানুষ আসত না , ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল এই অঞ্চল। দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকত এই স্থান। এখানে আসতেন কেবল নির্ভয় বীরাচারী তান্ত্রিকেরা তন্ত্র সাধনা করতে। আর এই নলহাটিতেই বিরাজমানা দেবী নলাটেশ্বরী।

 

Nalateswari1

 

এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেবী নলাটেশ্বরীর মন্দির। পুরাণের উপাখ্যান অনুযায়ী এখানে দেবী সতীর গলার হাড় বা নলি পড়েছিল। সংস্কৃত শব্দ 'নলক' যার অর্থ লম্বা হাড়, বাংলায় তারই অপভ্রংশ হল 'নলা'। মন্দিরের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল, তা নিয়ে কিন্তু বেশ কয়েকটি কাহিনী বা মত প্রচলিত রয়েছে। একটি মতবাদ হল প্রায় ৫০০ বছর আগে স্মরনাথ শর্মা নামে এক সাধক স্বপ্ন দেখেছিলেন যে মা কালী তাকে বলছেন যে ওই স্থানে দেবীর নলি পড়েছে, সেখানে তিনি নলাটেশ্বরী দেবী রূপে অবস্থান করছেন। সাধক যেন সতীর অঙ্গ উদ্ধার করে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। স্মরনাথ শর্মা সেই স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবীর আদেশ মতোই কাজ করেছিলেন।

তিনিই এই স্থানটি আবিষ্কার করে দেবীর নিত্যপুজার ব্যবস্থা ও মাহাত্ম্য প্রচার করেন। এই সাধকের বংশধররাই নাকি বংশ পরম্পরায় দেবীর পুজো করে আসছেন। নলাটেশ্বরী মন্দির নিয়ে অপর যে মতটি প্রচলিত, তা হল কাশীধামে ব্রহ্মচারী কামদেব নামে এক হরগৌরী উপাসক সাধক সন্ন্যাসী ছিলেন। ২৫২ বঙ্গাব্দে তিনিই একদিন মাতা গৌরীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে বীরভূমে এসে ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ললাট পাহাড়ের ওপর বেদী নির্মাণ করে তার উপর দেবী নলাটেশ্বরীকে প্রতিষ্ঠা করেন।বর্গীসর্দার ভাস্কর পণ্ডিত নাকি এখানে পুজো দিতে আসতেন।

পীঠ নির্ণয়তন্ত্র গ্ৰন্থের বর্ণনায় চৌত্রিশতম শক্তিপীঠ হল নলহাটী। এই গ্ৰন্থে বর্ণিত রয়েছে-

"নলাহাট্যাং নলাপাতো যোগীশো ভৈরবস্তথা।
তত্র সা কালিকা দেবী সর্বসিদ্ধি প্রদায়িকা।"

এই পীঠে পীঠরক্ষক হলেন দেবীর ভৈরব "যোগেশ্বর" মহাদেব। নলাটেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্যশিল্প বহু প্রাচীন। মূল মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন নাটোরের রানী ভবানী। চারচালা মন্দিরের গর্ভৃগৃহে কালিকারূপী দেবী নলাটেশ্বরীর প্রস্তরমূর্তি। এখানে দেবীর অপর নাম শেফালিকা। জনশ্রুতি, নলাটেশ্বরী মায়ের প্রস্তরমূর্তি উদ্ধারের সময় একটি অলৌকিক কাণ্ড হয়। অনাদির আদি শ্রীশ্রী বিষ্ণুর চরণ চিহ্নিত একটি শিলা পাওয়া গিয়েছিল।

 

Nalateswari2

 

ভগবান বিষ্ণুর সেই পদচিহ্ন সমন্বিত শিলা এখানে দেবীর সাথে পূজা করা হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকার মুখে মূল দরজার ওপরে রয়েছে একটি গণেশ মূর্তি, এই মূর্তিকে ঘিরে রয়েছে আটটি সাপ। প্রায় চার ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট প্রস্তর মূর্তির মুখমণ্ডল সিঁদুরে রাঙানো। মাথার ওপর রূপোর ছাতা। দেবীর ত্রিনেত্র অর্থাত্‍ তিনটি চোখ এবং দুদিকে দাঁতের মধ্যস্থলে সোনার তৈরি বিশাল জিহ্বা। সিঁদুরচর্চিত মুখমণ্ডলের নিচে থাকে রয়েছে মায়ের কন্ঠনালী।

প্রতিদিন সূর্যোদয়ের পর দেবীর অঙ্গরাগ হয়। ভোরবেলায় মায়ের স্নান ও শৃঙ্গারের সময়ে এই কণ্ঠনালীর দর্শন পান ভক্ত দর্শনার্থীরা। আগত দর্শনার্থীরা চাইলে নিজের হাতে মাকে স্নান করিয়ে মঙ্গলারতি করতে পারেন। ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। দেবী নলাটেশ্বরীর পুজোর প্রধান উপকরণ চাঁছি ও পেঁড়ার সন্দেশ। এই মন্দিরে প্রতিদিনই দেবীর পূজা অর্চনা হলেও বছরে দু’বার বিশেষ পুজো হয়। দেবী এখানে কালিকা রূপে পূজিত হন।

দুর্গাপুজোর চারদিন মা'কে দেবী দুর্গা রূপে পুজো করা হয়। আর কালীপুজোর দিন মা নলাটেশ্বরীর বিশেষ পুজো করা হয়। এই মন্দিরে এখনও বলি প্রথা চালু আছে। দুর্গাপূজার নবমী ও কালীপূজার দিন অবশ্যই বলি হয়। এমনিতে বছরের ৩৬৫ দিনেই এখানে দেবীমাকে আমিষ অন্ন ভোগ দেওয়া হয়। সারা বছরই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দেবী মায়ের কাছে ভক্ত সমাগম হয়ে থাকে।

মন্দিরের উত্তর দিকে রয়েছে পঞ্চমুন্ডির আসন। ১২৯৬ সালে স্বামী কুশলানন্দ ব্রহ্মচারী নামের এক সন্ন্যাসী কাশী থেকে এসে নলহাটিতে পঞ্চমুন্ডি আসন প্রতিষ্ঠা করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। মন্দিরের উত্তরে আজও রয়েছে সেই পঞ্চমুন্ডির আসন। স্বয়ং বামদেব তারাপীঠ থেকে এই পীঠস্থানে প্রায়ই আসতেন এবং চারদিন-পাঁচদিন থেকে যেতেন। এই মন্দিরের জন্য রানী ভবানী তিনশো পঁয়ষট্টি বিঘা জমি দান করেছিলেন।

ভক্তের মনবাসনা পূর্ণ করেন অতি জাগ্ৰত দেবী নলাটেশ্বরী। দেবীর প্রনাম মন্ত্র দিয়ে শেষ হোক আজকের পর্ব -

"মঙ্গলাং শোভনাং শুদ্ধাং নিস্কলং পরমম্ কলাং।
নলাটেশ্বরী বিশ্বমাতা চণ্ডিকাং প্রণমাম্যহম্ ।।"

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...