বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ: দেবী যোগাদ্যা

বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ সিরিজের এবারের পর্বে আছেন দেবী যোগাদ্যা। পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার অন্তর্গত ক্ষীরগ্ৰামে অধিষ্ঠিতা মা যোগাদ্যা দেবী দুর্গার একটি রূপ। পুরাণ মতে দক্ষযজ্ঞের পর যখন মহেশ্বর শিব পত্নী সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে এই বিশ্বকে ধ্বংস করার নেশায় মেতে উঠে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেছিলেন তখন ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহকে একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করে দিলে দেবাদিদেব শান্ত হয়ে আবার ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন। দেবী সতীর শরীরের খণ্ডাংশগুলি ভারত সহ আরো চারটি দেশের একান্নটি স্থানে পতিত হয়েছিল। এই স্থানগুলি এক একটি সতীপীঠরূপে পরিচিতি লাভ করেছে যার অন্যতম হল আমাদের আজকের উপজীব্য "যোগাদ্যা সতীপীঠ"।

yogoda

পীঠনির্ণয় তন্ত্র মতে অষ্টাদশ পীঠ হল ক্ষীরগ্ৰামের যোগাদ্যা সতীপীঠ। এই গ্ৰন্থে দেবীকে "যুগাদ্যা" বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

"ক্ষীরগ্ৰামে মহাদেব ভৈরব: ক্ষীরগ্ৰাম

যুগাদ্যা সা মহামায়া দক্ষাঙ্গুষ্ঠাং পদোমম"

বহু প্রাচীন গ্ৰন্থে এই ক্ষীরগ্ৰামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এর সবচেয়ে প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া গেছে "কুব্জীকাতন্ত্র" গ্ৰন্থে। তবে মধ্যযুগ থেকে এই ক্ষীরগ্ৰামের নাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল মঙ্গলকাব্যের হাত ধরে। প্রচলিত আছে যে এখানে দেবীর ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল পতিত হয়েছিল। দেবীর ভৈরব হলেন ক্ষীরকন্ঠক মহাদেব। ক্ষীরগ্ৰাম এবং দেবী যোগাদ্যার আখ্যান কিন্তু বহু প্রাচীন।

কৃত্তিবাসের রামায়নে লেখা আছে যে দেবী যোগাদ্যা ছিলেন পাতালে মহীরাবণের আরাধ্যা দেবী। মহীরাবণ এবং তার ভাই অহিরাবণকে শ্রীরামচন্দ্র বধ করেন। এরপর দেবী সঙ্কটমোচন হনুমানকে বলেন তাঁকে পাতাল থেকে তুলে নিয়ে পৃথিবীতে স্থাপন করতে। তখন দেবীর নির্দেশ মতো হনুমান দেবীকে পাতাল থেকে তুলে এনে ক্ষীরগ্ৰামে স্থাপন করেন। কাশীরাম দাসের মহাভারতের শান্তিপর্বেও হনুমান কর্তৃক দেবী যোগাদ্যাকে পাতাল থেকে আনয়ন এবং ক্ষীরগ্ৰামে স্থাপনের কাহিনী রচিত রয়েছে।

এবার মা যোগাদ্যাকে একটু বর্ণনা করা যাক‌। দেবী যোগাদ্যা বছরের মধ্যে তিনশো ঊনষাট দিন থাকেন জলের নীচে। ভক্তের ডাকে মাত্র ছ'দিনের জন্য উঠে আসেন তিনি। একটু বিস্তারিত ভাবে বলা যাক বিষয়টি। দেবী যোগাদ্যার কালো কষ্টিপাথরে তৈরি সিংহবাহিনী মূর্তিটি রাখা হয় মন্দির সংলগ্ন ক্ষীরকুণ্ড নামের একটি দিঘির জলের নীচে। প্রত্যেক বছর মাত্র ছদিনের জন্য এই মূর্তি জল থেকে তুলে এনে পূজা অর্চনা করা হয়। এর মধ্যে মাত্র দু' দিন দেবীর দর্শন পান ভক্তরা--- বৈশাখী সংক্রান্তির আগের দিন এবং জ্যৈষ্ঠের ৪ তারিখে। বাকি চার দিন, আষাঢ়ী নবমী, বিজয়াদশমী, ১৫ই পৌষ এবং মাঘ মাসের মাকুরী সপ্তমীতে দেবীকে জল থেকে তুলে মন্দিরে পুজো করা হলেও তাঁকে সাধারণ মানুষজনের দর্শনের অনুমতি থাকে না। কিন্তু দেবী জলবাসিনী কেন? প্রচলিত কাহিনী এইই যে মহীরাবণ বধের পর তার পত্নী ক্ষোভে দুঃখে দেবী যোগাদ্যার বিগ্ৰহ জলে ফেলে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই দেবীর জলেই বাস।

"রানী বলে এই ছিল যোগাদ্যার মনে

 এতকাল পূজা খেয়ে মারিল রাজনে।

আগে গিয়া প্রতিমা ডুবায়ে দিব জলে

নর বানরের প্রাণ লব শেষ কালে"।।

কৃত্তিবাসী রামায়নেই লেখা আছে যে মহীরাবণের আরাধ্যা হওয়া সত্ত্বেও দেবী যোগাদ্যা হনুমানকে বলে দিয়েছিলেন কীভাবে রাম মহীরাবণকে বধ করতে পারবেন।

দেবী যোগাদ্যার পূজার ইতিবৃত্ত নিয়ে প্রচলিত আছে আরও এক কাহিনী। শোনা যায় বহু পূর্বে হরিদত্ত নামে এক রাজা দেবী আদেশে শুরু করেছিলেন তাঁর পূজা ৷ কিন্তু এই পূজা তিনি করতেন নরবলি দিয়ে ৷ রাজা তার রাজ্যের সমস্ত পরিবারের জন্য এই নিয়ম চালু করেন যে প্রত্যেক পরিবারের একজন পুরুষ সদস্যকে প্রতি পূজায় বলি দেওয়া হবে। এই আদেশে স্বাভাবিকভাবেই শোকের ছায়া নেমে আসে প্রজাদের পরিবারের মধ্যে ৷ নিয়মানুসারে একদিন পুরোহিত ব্রাহ্মণের পালা পড়ে; তার একমাত্র ছেলের প্রাণদান করতে হবে। ভীত সন্ত্রস্ত ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী মাঝরাত্রিতে ছেলেকে নিয়ে গ্রাম পরিত্যাগ করে দূরদেশে রওনা দেন‌‌। কিন্তু পথমধ্যে দেবী যোগাদ্যা তাকে দর্শন দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন তাদের গ্রামে প্রত্যাবর্তন করতে এবং তাঁর আদেশে নরবলির পরিবর্তে শুরু হয় মহিষবলি ৷ দেবী হয়ে ওঠেন   মহিষমর্দ্দিনী জগদীশ্বরী। কিন্তু প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি কোনও ভাবে হারিয়ে গিয়েছিল।

বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ্র এই ক্ষীরগ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির নির্মাণ করান। এবং তারই আদেশে দাঁইহাটের বিখ্যাত প্রস্তর শিল্পী নবীনচন্দ্র ভাস্কর হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি তৈরি করে দিলেন। নতুন তৈরি হওয়া মূর্তিটি অবশ্য বছরের অন্যান্য সময়ে ডুবিয়ে রাখা হত ক্ষীরদিঘির জলেই। কেবল ৩১ বৈশাখ তা জল থেকে তুলে এনে ভক্তদের দর্শনের জন্য রাখা হত। কিন্তু হঠাৎই ঘটে যায় এক অলৌকিক ঘটনা। ( ক্ষীরগ্রামের মানুষ এই ঘটনাকে অলৌকিক বলেই দাবি করেন)। কয়েক বছর আগে, ক্ষীরদিঘি সংস্কারের সময় নতুন মূর্তির সঙ্গে 'হারিয়ে যাওয়া' পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটিকেও পাওয়া যায়। দেবীর প্রাচীন মূর্তি ফিরে পাওয়ার আনন্দে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দা সহ গ্রামের মানুষ গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ নতুন একটি মন্দির। সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হল ফিরে পাওয়া প্রাচীন দেবী-মূর্তি। এখন গ্রামে গেলেই ভক্তরা দর্শন পান দেবীর। তবে বৈশাখ মাসের সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই চলে দেবীর পূজা আরাধনা। হয় বিশাল উৎসব।

লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ ভক্ত আসেন দেবীর দর্শন প্রার্থী হয়ে। বৈশাখী সংক্রান্তি এবং চৌঠা জ্যৈষ্ঠ এই দুদিন ভক্তরা দেবীর দর্শন লাভ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। পুজোর পর দেবী আবার ফিরে যান ক্ষীরদিঘির জলে। এমনিতে নতুন মন্দিরে প্রতিদিনই নিত্য পূজার ব্যবস্থা রয়েছে। কাঁচা ছোলা এবং পাটালি দেবীর পূজার প্রধান উপকরণ। দেবীকে প্রতিদিন আমিষ সহ অন্নভোগ নিবেদন করা হয়।

বার্ষিক পূজায় ছাগ, মেষ, মহিষ বলির নিয়ম রয়েছে। বলির রক্ত ক্ষীরদিঘিতে নিবেদিত হয়। ক্ষীরগ্ৰামের আজও কিছু বিশেষ নিয়ম প্রচলিত। যেমন (১) এখানে কোনো প্রতিমা গড়ে দুর্গা পূজা হয় না। (২) বৈশাখ মাসে মাঠে লাঙল চালানো, মাটি খোঁড়া, চাল উৎপাদন, মাথায় ছাতা দেওয়া, স্বামী স্ত্রীর একশয্যায় শয়ন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। (৩) ক্ষীরগ্ৰামে উত্তরদুয়ারী গৃহ নির্মাণ নিষেধ। (৪)হলুদ বাঁটা ও সলতে পাকানো নিষেধ এই মাসে। প্রবীণ মানুষরা এসব নিয়ম এখনো মেনে চলেন। দেবী যোগাদ্যার পুজো না দিয়ে ক্ষীরগ্ৰামে এখনো কেউ কোনো শুভ কাজ শুরু করেন না।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...