সতীপীঠ- শব্দটি উচ্চারিত হলে অথবা শ্রুত হলে মনে যেন অপার কৌতূহল এবং কেমন এক ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়। এ যেন এক অমীমাংসিত রহস্যময় কুহেলিকাবৃত যাত্রাপথ। প্রত্যেকটি শক্তিপীঠ কিন্তু সাধারণ মন্দির থেকে আলাদা। কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই দেবস্থানগুলিতে যে বৈশিষ্ট্যগুলি এই পীঠস্থানসমূহে বিশেষ মাহাত্ম্য যুক্ত করেছে। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে কোনও শক্তিপীঠে দেবীর আরাধনা করলে সমস্ত দুঃখ বেদনা দূর হয়, লাভ হয় সমৃদ্ধি, সুখ, শান্তি। এই পবিত্র স্থানগুলি ভারতের তথা বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবহ এবং এগুলি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হিসেবে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থেও উল্লিখিত হয়েছে।
ব্রহ্মা পুরাণে বর্ণিত আছে প্রাণ সৃষ্টির অভিপ্রায়ে ব্রহ্মা তাঁর কয়েকজন মানসপুত্রকে সৃষ্টি করেছিলেন যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রজাপতি দক্ষ। ব্রহ্মার শরীরের ডানদিক থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন দক্ষ। স্বয়ং আদ্যাশক্তি মহামায়া তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা সতী রূপে জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন। পিতার আপত্তি সত্ত্বেও তিনি দেবাদিদেব মহাদেবকে বিবাহ করেছিলেন।
এর পরবর্তী কাহিনী আমাদের জানা। আমন্ত্রণ না জানানো সত্ত্বেও অনাহুত অতিথি রূপে দক্ষ-আয়োজিত যজ্ঞে উপস্থিত হয়েছিলেন দেবী সতী এবং সেখানে তাঁর পিতা দক্ষ কর্তৃক মহাদেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞাগ্নিতে প্রাণাহুতি দিয়েছিলেন।
প্রাণাধিক প্রিয় পত্নীর মৃত্যুতে শোকে এবং ক্রোধে মহাদেব উন্মত্ত হয়ে সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে সমগ্ৰ বিশ্ব ধ্বংসের উদ্দেশ্যে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। ভগবান বিষ্ণু তখন তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ একান্ন খণ্ডে বিভক্ত করে দিয়েছিলেন। তারপর শান্ত হয়েছিলেন মহেশ্বর।
দেবী সতীর শরীরের খণ্ডাংশগুলি এবং তাঁর অলঙ্কাররাজি পৃথিবীতে পড়া মাত্র পাথরে পরিণত হয়েছিল। যেখানে যেখানে সেই দেহাংশ পতিত হয়েছিল সেই স্থানগুলি একেকটি শক্তিপীঠ বা সতীপীঠরূপে পরিচিত হয়। এই প্রস্তরীভূত দেহখণ্ডগুলি রক্ষা করার জন্য প্রত্যেক পীঠে থাকেন পীঠরক্ষক ভৈরব। ভৈরব মহাদেবের প্রতিরূপ। প্রতিটি শক্তিপীঠে ভৈরবের মন্দির রয়েছে।
এবারের শক্তিপীঠ পর্বে আলোচ্য সতীপীঠ নন্দিকেশ্বরী মন্দির। বীরভূম জেলায় অবস্থিত পাঁচটি (মতান্তরে ছ'টি) শক্তিপীঠের অন্যতম পীঠ দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দির মন্দির যা নন্দিকেশ্বরী মন্দির তলা নামেও পরিচিত। এটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া শহরে অবস্থিত। শহরের মোটামুটি মাঝখানে অবস্থিত নন্দিকেশ্বরী মন্দিরকে ঘিরে কিংবদন্তী কিছু কম নেই।
এই সাঁইথিয়ার আগে নাম ছিল নন্দীপুর। তন্ত্রচূড়ামণি গ্ৰন্থে নন্দিকেশ্বরী মন্দির শক্তিপীঠকে মূল পীঠ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে নন্দিকেশ্বরী মন্দিরকে পঞ্চাশতম পীঠ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। আবার "পীঠনির্ণয়তন্ত্র" গ্ৰন্থে এটিকে ঊনপঞ্চাশতম সতীপীঠ বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত শক্তিপীঠের একটি হল দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দির মন্দির। দেবীর অপর নাম নন্দিনী। পীঠনির্ণয়তন্ত্রেই দেবী নন্দিনীকে "মহাদেবী" রূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং লেখা আছে এই নন্দীপুরে দেবীর গলার হার পড়েছিল। এখানে দেবীর ভৈরবের নাম "দেব নন্দীকেশ্বর"।
"হার পাতো নন্দিপুরে ভৈরব নন্দীকেশ্বর
নন্দিনী সা মহাদেবী তন্ত্র সিদ্ধি ভবাপ্নুরাত্"....
অন্যদিকে পীঠমালাতন্ত্র মতে দক্ষযজ্ঞের পর দেবীর কণ্ঠহাড় নাকি এখানে পড়েছিল। সেই গ্ৰন্থে রয়েছে
"হাড় পাতো নন্দীপুরে ভৈরব নন্দীকেশ্বর
নন্দিনী সা মহাদেবী তন্ত্র সিদ্ধির্ণসংশয় "....
স্বয়ং বামদেব, বামাক্ষ্যাপা নামে যিনি অধিক পরিচিত, এই নন্দিকেশ্বরী মন্দির পীঠে সাধনা করে সিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। জনশ্রুতি, বামদেব যখন তারাপীঠে সাধনা করছিলেন তখন দেবী নন্দিনী তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন তাঁর পুজো করলে তবেই সিদ্ধিলাভ করতে পারবেন বামাক্ষ্যাপা। তারপরই বামদেব এখানে এসে পুজো করেন।
ময়ূরাক্ষী নদীর কোলে এই মন্দির। এক বিশাল বটগাছ ছাতার মত ঘিরে রেখেছে নন্দিকেশ্বরী মন্দির মন্দির প্রাঙ্গনটিকে। কথিত, এই বটগাছের নীচেই দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দিরর অবস্থান।দেবীর নামটি 'নন্দী' থেকে এসেছে। শিবের বাহন, অনুসরণকারী নন্দী এবং তার ঈশ্বরী মানে আরাধ্যা দেবী। মন্দিরের মধ্যে একটি উঁচু বেদীর উপর বিশাল ত্রিভুজাকৃতি পাথরখণ্ড। এই প্রস্তরখণ্ডটিতে তেল সিঁদুর মাখানোর ফলে শিলাটি লোহিত বর্ণ ধারণ করেছে।
তার গায়ে রূপার চোখ নাক মুখ বসিয়ে দেবীর মূর্তির রূপ দেওয়া। বটবৃক্ষের তলে কোটরেই বিরাজ করছেন দেবীর ভৈরব দেব নন্দীকেশ্বর মহাদেব। মন্দিরের পিছনে রয়েছে কুণ্ড পুকুর। তন্ত্র মতে একটি শক্তিপীঠ যে স্থানে থাকবে সেই স্থানের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন সেই স্থানটি পাশাপাশি জায়গা থেকে উঁচু হবে। উত্তরে নদী, পাশে থাকবে কুণ্ড এবং কাছেই থাকবে শ্মশান। এই সবকটি বৈশিষ্ট্য নন্দিকেশ্বরী পীঠে বিদ্যমান। অনেক বার এমন হয়েছে যে সাঁইথিয়া শহর বন্যায় ভেসে গেছে কিন্তু দেবীর মন্দির চত্বরে একফোঁটা জল ওঠেনি। অর্থাৎ মায়ের থানটি পাশাপাশি জায়গা থেকে উঁচুতে অবস্থিত। মন্দিরের উত্তরদিকে বইছে ময়ূরাক্ষী। এবং নিকটেই শ্মশান।
শোনা যায়, দেবী নিজেই স্বপ্ন দিয়ে তাঁর অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন দাতারাম ঘোষ নামে এক ভবঘুরে মানুষকে। দাতারাম আদতে দক্ষিণেশ্বরের অধিবাসী হয়েও ভাগ্য অন্বেষণে বীরভূমে চলে এসেছিলেন। দেবীর কৃপা লাভ করে তার ভাগ্য ফিরে গিয়েছিল।
তিনি পরে দেওয়ান হওয়া থেকে শুরু করে জমিদারি কিনে জমিদার হয়েছিলেন। এই দাতারাম ঘোষ যখন প্রথম নন্দীপুরে এসেছিলেন তখন একদিন যাত্রাপথে ক্লান্ত হয়ে একটি বটগাছের তলায় শুয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তিনি স্বপ্নে দেখেন এক দেবী তাকে বলছেন "আমি দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দির এই বটবৃক্ষ মূলে অবস্থান করছি। তুই আমার পুজোর ব্যবস্থা কর"। এরপর থেকেই দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দিরর পুজোর প্রচলন করেন তিনি। দেবীর আশিসে তিনি প্রচুর ধন সম্পদ লাভ করেন। 'সাইত' করে মহাল কিনেছিলেন বলে 'সাইতা'- আর সেখান থেকেই এই শহরের নাম দাঁড়ায় সাঁইথিয়া।
দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দিরর নামেই একসময় সাঁইথিয়া শহরের নাম ছিল নন্দীপুর। দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দিরই এই সাঁইথিয়া শহর এবং সংলগ্ন এলাকার আরাধ্যা দেবী। নন্দিকেশ্বরী মন্দির পীঠের শান্ত ধ্যানগম্ভীর পরিবেশ এখনও অটুট।
চণ্ডীর পঞ্চম অধ্যায়ের মা দুর্গার ধ্যান মন্ত্রে এই পীঠে মা নন্দিনীকে পুজো করা হয়। কলা, বাতাসা দিয়ে দেবীকে ভক্তরা পুজো দিতে পারেন। দেবীকে প্রতিদিন অন্নভোগ নিবেদন করা হয় এবং তাতে একটি আমিষ পদ থাকে। একই সঙ্গে দেব নন্দীকেশ্বরেরও পুজো হয়। পৌষ মাসে মন্দিরে বার্ষিক বিরাট পুজো ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
সংস্কারের পর বর্তমানে এই মন্দির এবং মন্দির প্রাঙ্গণ সুসজ্জিত। নন্দিকেশ্বরী সতী মায়ের মন্দির ছাড়াও মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে আরও একাধিক মন্দির। এখানে কালী, কৃষ্ণ রয়েছেন পাশাপাশি। মহাসরস্বতী, মহালক্ষ্মী, বিষ্ণুলক্ষ্মী, জলারামবাবার মন্দির, হনুমান মন্দির, জগন্নাথদেবের মন্দির, কালীয়দমন মন্দির ঐ একই প্রাঙ্গনে নির্মিত হয়েছে। সারা বছরই দেবীর দর্শনাকাঙ্ক্ষায় নন্দিকেশ্বরী মন্দিরে ভক্তদের আগমন ঘটে। নববর্ষ, বিজয়া দশমী, বিভিন্ন ব্রত পার্বণে এখানে মানুষের ভিড় উপচে পড়ে।
আজ ও সাঁইথিয়া শহরের ব্যবসায়ীরা মা নন্দিকেশ্বরীর কাছে পুজো দিয়ে তাদের নববর্ষ শুরু করেন। সাঁইথিয়া স্টেশনের কাছেই নন্দিকেশ্বরী মন্দির মন্দির। মোটামুটি শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে নন্দিকেশ্বরী মন্দির মন্দিরের অবস্থান। এ রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরের সঙ্গে সাঁইথিয়া যাতায়াতের সরাসরি বাস বা ট্রেন যোগাযোগ আছে। সেই কারণেই এই সতীপীঠে পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধি পেয়েছে। যুগ যুগ ধরে ভক্তদের আশা আকাঙ্খা পূরণ করে চলেছেন দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দির।