বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ: মা কঙ্কালীতলা মন্দির

বোলপুর- এই নামটির সঙ্গে সমস্ত বাঙালি পরিচিত। কারণ বোলপুরে অবস্থিত শান্তিনিকেতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। রাজ্য বা দেশ থেকে তো বটেই, সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকদের ভিড় জমে শান্তিনিকেতনে। আর শান্তিনিকেতন বেড়াতে গেলে বেশিরভাগ বাঙালি যেখানে যেতে ভোলেন না সেই জায়গাটি হল কঙ্কালীতলা। বীরভূম জেলার বোলপুর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে কোপাই নদীর তীরে কঙ্কালীতলা মন্দির।

কী এমন বিশেষত্ব আছে এই মন্দিরের যে মানুষ ছুটে ছুটে আসেন এখানে পুজো দিতে? আছে, বন্ধু আছে। এই কঙ্কালীতলা মন্দির একটি সতীপীঠ। সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম পীঠ বোলপুরের কঙ্কালীতলা মন্দির। পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় তো অবশ্যই, এই শক্তিপীঠ স্থানীয়দের কাছেও অতি প্রসিদ্ধ।

 

Kankalitala1

 

এখনকার বোলপুরের প্রাচীন নাম ছিল কাঞ্চীনগর। পীঠনির্ণয়তন্ত্র অনুযায়ী আঠাশতম এবং শিবচরিতে উল্লিখিত সপ্তত্রিংশৎ অর্থাৎ সাঁইত্রিশতম শক্তিপীঠ এই কঙ্কালীতলা। দেবীর নাম এখানে দেবগর্ভা(মতান্তরে বেদগর্ভা) এবং তাঁর ভৈরব মহাদেব রুরু।

"কাঞ্চীদেশে চ কঙ্কাল ভৈরবো রুরু নামকঃ

দেবতা দেবগর্ভাখ্যা।।"

এই কাঞ্চীর সঙ্গে কিন্তু দক্ষিণ ভারতের কাঞ্চীপুরমের কোনো সম্পর্ক নেই। ইতিহাস থেকে জানা যায় পালযুগে এই অঞ্চলে কাঞ্চীরাজ রাজেন্দ্র চোল সেনাশিবির স্থাপন করেছিলেন। তখন থেকেই এই স্থানের নাম হয়েছিল কাঞ্চীনগর।

 

Kankalitala2

 

কোনও কোনও গ্ৰন্থে বলা হয়েছে এখানে দেবী সতীর কঙ্কাল পতিত হয়েছিল আবার ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে বলা হয়েছে, এই স্থানে দেবীর ‘কাঁকাল’ বা কটিদেশ অর্থাৎ কোমরের অংশ পড়েছিল যা থেকে এই জায়গার নাম হয় কঙ্কালীতলা।

“কাঞ্চীদেশে পড়িল কাঁকলি অভিরাম

বেদগর্ভা দেবতা ভৈরব রুরু নাম।।”

কঙ্কালীতলা মন্দিরের পাশেই রয়েছে বিশাল কুণ্ড। এখানকার প্রধান আকর্ষণই হল কুণ্ড। এই কুণ্ডের জল কোনওদিন শুকিয়ে যায় না। জনশ্রুতি, এই কুণ্ডের সঙ্গে কাশীর মণিকর্ণিকা ঘাটের যোগ রয়েছে। এখানে কুণ্ডের ঈশান কোণে নাকি প্রস্তরীভূত অবস্থায় নিমজ্জিত আছে মায়ের কাঁকাল। সাধকরা সেগুলোকে দেবীর দেহের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই প্রস্তর খণ্ডগুলি বারো বছর অন্তর কুণ্ড থেকে তোলা হয়, সেগুলিকে পরিমার্জনের পর পুজো করা হয়। পুজোর পর সেগুলিকে আবার কুণ্ডের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কুণ্ডের জল অতি পবিত্র বলে মনে করা হয়। এই কুণ্ডে কেউ পা দেয় না বা স্নান করে না।

 

Kankalitala3

 

এখানে আগে কোনও মন্দির ছিল না। একটি বেদী ছিল শুধু। পরে মন্দির নির্মাণ করা হয়। এখানে দেবীর কোনও মূর্তি নেই। একটি বাঁধানো ছবিতে মায়ের পুজো করা হয়। জনশ্রুতি, এই বেদীর নীচে একশো আটটি নরমুণ্ড রয়েছে। কাছেই মহাশ্মশান এবং কোপাই নদী। অর্থাৎ শক্তিপীঠ-এর সমস্ত বৈশিষ্ট্য এই স্থানে রয়েছে। পাশেই রয়েছে রুরু মহাদেবের মন্দির। কালীপুজোর সময় অতি জাঁকজমক সহকারে মায়ের পুজো হয়। এছাড়া দক্ষিণাকালিকার ছবি এবং স্থাপিত ঘটে দেবীর নিত্য পুজো হয়। দেবী এখানে করালবদনা নন, কোমল, শান্তিময়ী মা। দুর্গাপুজোর পর শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে এই সতীপীঠে একান্ন কুমারী পুজো করা হয়।

গুপ্ত তন্ত্রসাধনার জন্যও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে কঙ্কালীতলা সতীপীঠ। সারাদেশ থেকে সাধকদের আগমনের পাশাপাশি এখানে সারা বছর সাধারণ পর্যটকদের বা ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...