বঙ্গভূমির শক্তিপীঠঃ কিরিটকোণা সতীপীঠ

সতীপীঠ সিরিজের অষ্টম পীঠপর্বে এসে গিয়েছি আমরা। এবারের পর্ব ‘দেবী কিরীটেশ্বরী মন্দির’। মুর্শিদাবাদ জেলার একমাত্র সতীপীঠ হল দেবী কিরীটেশ্বরী মন্দির। পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুযায়ী এখানে দক্ষযজ্ঞে দেবী সতীর দেহত্যাগের পর দেবীর কিরীট বা মুকুটটি পতিত হয়েছিল। অবশ্য অপর একটি মত বলছে, যে এখানে দেবীর কপালের উপরের অংশ অর্থাৎ করোটি পড়েছিল। দেবী সতীর পিতা প্রজাপতি দক্ষ শিবহীন যজ্ঞ করে ত্রিভুবনে মহাদেব শিবের সম্মানকে ভুলুণ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।

 

Kiriteswari1

 

সব দেবতাকে আমন্ত্রণ জানালেও দেবাদিদেব মহাদেবকে তিনি আমন্ত্রণ জানান নি কারণ তার কন্যা সতী দক্ষের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে মহেশ্বরকে বিবাহ করেছিলেন।কিন্তু বিনা আমন্ত্রণেই তার বিবাহিতা কন্যা অর্থাৎ শিবের পত্নী সতী যজ্ঞে উপস্থিত হন। সেখানে দক্ষ রাজা শিবকে চূড়ান্তভাবে কটূক্তি করে। স্বামী-নিন্দা সহ্য করতে না পেরে আগুনে প্রাণাহুতি দেন সতী। সতীর মৃত্যুর খবর পেয়ে ক্রোধে এবং শোকে উন্মত্ত শিব এসে ধ্বংস করেন দক্ষযজ্ঞ। স্ত্রীর প্রাণহীন মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন। সারা বিশ্বে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে। তখন ভগবান বিষ্ণু এই সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য তার সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহকে একান্নটি খণ্ডে ছিন্ন করেন। সেই খণ্ডগুলো যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একেকটি সতীপীঠ শক্তিপীঠ গড়ে ওঠে। এই গুলো হিন্দুদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র তীর্থস্থান।

এই সতীপীঠ বা শক্তিপীঠগুলিতে দেবী সতীর দেহের প্রস্তরীভূত অঙ্গগুলি ও অলঙ্কারগুলি রক্ষিত আছে। প্রত্যেক "পীঠস্থানে" দাক্ষায়ণী দুর্গা বিভিন্ন রূপে পূজিতা হন এবং সেই পীঠের পীঠরক্ষক "ভৈরব" ঐ দেবীর স্বামী (সঙ্গী), যারা মহেশ্বর শিবের বিভিন্ন রূপ। সাধারণত ৫১টি শক্তিপীঠের কথা বলা হয়ে থাকলেও, গ্ৰন্থভেদে পীঠের সংখ্যা ও অবস্থান নিয়ে ভিন্নমত আছে। কিরীটেশ্বরী পীঠকে কোনো পৌরাণিক গ্ৰন্থে মূল পীঠ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে আবার কোথাও "উপপীঠ" বলা হয়েছে।

 

Kiriteswari2

 

মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ কোর্ট স্টেশন থেকে মাইল তিনেক দূরে কিরীটকণা' (বা 'কিরীটকোণা') গ্রামে এই সতীপীঠ। দেবী সতীর কিরীট বা মুকুট পড়েছিল বলেই এই গ্ৰামের নাম হয়েছিল কিরীটকোণা। রাঢ় বাংলার প্রাচীন পীঠস্থানগুলির মধ্যে অন্যতম এই কিরীটকোণা। মন্দিরে দেবীর কোনও প্রতিমা নেই, একটি উঁচু পাথরের বেদী, সেই বেদীর উপর আরেকটি ছোট বেদী আছে। এই ছোট বেদীটিকেই দেবীর কিরীট বা মুকুট রূপে পূজা করা হয়। এই মন্দিরটির বয়স প্রায় দু’শো বছর। এই পীঠে দেবী 'বিমলা' এবং তাঁর ভৈরব 'সম্বর্ত' নামে পূজিত হন। পীঠ নির্ণয়তন্ত্রে এই পীঠকে  "দ্বাবিংশতম" বা বাইশতম পীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

"ভুবনেশী সিদ্ধিরূপা কিরিটস্থা কিরীটতঃ

দেবতা বিমলা নাম্নি সংবর্তো ভৈরবস্তুথা"......

মহানীল তন্ত্র অনুযায়ী এই পীঠকে একটি মহাপীঠের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

“কালীঘট্টে উহ্যকালী কিরীটেচ মহেশ্বরী

কিরীটেশ্বরী মহাদেবী লিঙ্গাখ্যে লিঙ্গবাহিনী”

 

Kiriteswari3

 

এখানে দেবী কিরীটেশ্বরীর দুটি মন্দির আছে। রানী ভবানী প্রতিষ্ঠিত পুরনো মন্দিরটির এখন ভগ্নদশা। এই মন্দিরের চূড়া অদ্ভুতভাবে মাঝখান বরাবর দ্বিখণ্ডিত হওয়া। জনশ্রুতি, মহারাজা নন্দকুমার দেবী কিরীটেশ্বরীর ভক্ত ছিলেন। তার ইংরেজরা অন্যায় ভাবে ফাঁসি দিলে মন্দিরের চূড়া নাকি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। নতুন দেবীমন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন রাজা রাজবল্লভ। নতুন মন্দিরের চারিদিকে অনেক ছোট-ছোট মন্দির আছে। পাঠান-মুঘল শাসনকালেও এই পীঠস্থান তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাত ছিল। ১১৭৭ বঙ্গাব্দে বিজয়রাম সেন রচিত 'তীর্থ-মঙ্গল' কাব্যে কিরীটেশ্বরীর বর্ণনা আছেঃ

কিরীটেশ্বরী পূজা দিতে গেলা শীঘ্রগতি।

কথোগুলি বাত্রী গেলা কর্ত্তার সংহতি।।

মহাসরঞ্জাম সঙ্গে গিয়া কিরীটকোণা।

দেবীকে প্রণাম কৈল দিয়া কিছু সোনা।।

ষোড়শোপচারে পূজা কৈল ভগবানে।

দক্ষিণা করিলা কত কৈল বিতরণে।।

 

Kiriteswari4

 

পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবার এখানে বার্ষিক পুজো হয়। দুর্গা অষ্টমীর দিন দেবীরূপ পাথরখণ্ডটির পুরানো বস্ত্র ফেলে দিয়ে নতুন কাপড়ে আচ্ছাদিত করা হয়। দেবীর পূজা হয় দক্ষিনাকালীর ধ্যান মন্ত্রে। পাশেই দেবীর ভৈরবের মন্দির। রাজা রাজবল্লভের প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দিরও এখানে আছে।

কিরীটকোণা গ্রামের কিছুটা ভিতরে গুপ্তমঠ নামে এক নতুন মন্দিরে নাকি দেবী কিরীটেশ্বরীর কিরিট বা মুকুটটি রাখা আছে। নাটোরের রানী ভবানীর পুত্র রাজা রামকৃষ্ণ বড়নগর থেকে এখানে আসতেন মায়ের সাধনা করতে। এখনও মন্দির-প্রাঙ্গনে দুটি পাথরখণ্ড দেখা যায়, যার উপর বসে রাজা রামকৃষ্ণ সাধনা করতেন।

এই কিরিটকোনা ধাম আরও সুপরিচিত নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাতামহ বাংলার নবাব আলীবর্দি খানের জন্য, যিনি প্রত্যেক বছর, দোল যাত্রা বা বসন্ত উৎসব উপলক্ষে হিন্দুদের সঙ্গে আবীর দিয়ে রং খেলতেন। কথিত আছে মুর্শিদাবাদের নবাব মীরজাফর শেষ জীবনে কুষ্ঠরোগগ্রস্ত হলে তার হিন্দু দেওয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী কিরীটেশ্বরী দেবীর চরণামৃত পান করায় তার রোগ নিরাময় হলে তিনি মন্দিরের নিকটস্থ দিঘির সংস্কার করিয়ে দিয়েছিলেন।

স্থানীয় মানুষরা বলেন দেবী অতি জাগ্ৰতা। মন থেকে প্রার্থনা করলে মা কখনও তাঁর ভক্তদের ফিরিয়ে দেন না। হাজার বছর ধরে এই পীঠস্থানে বিরাজ করছেন দেবী কিরীটেশ্বরী মাতা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...