বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ: দেবী রত্নাবলী শক্তিপীঠ

‘বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ’ সিরিজের তৃতীয় পর্ব আজ। আজকের পর্বে যে শক্তিপীঠ নিয়ে এই লেখা সেই সতীপীঠ হল দেবী রত্নাবলী শক্তিপীঠ। এই মন্দিরটি  হুগলি জেলার খানাকুলে, রত্নাকর নদীর তীরে অবস্থিত।

পুরাণ অনুসারে ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দিয়েছিলেন। এতে দেবী সতীর দেহের একান্নটি টুকরো ভারতসহ  পৃথিবীর আরো কয়েকটা দেশে পড়ে। পৃথিবীতে পড়ামাত্রই সেগুলি প্রস্তরখণ্ডে পরিণত হয়। এই জায়গাগুলিই আজ শক্তি আরাধনার পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত।

একান্ন সতীপীঠের অন্যতম পীঠ আমাদের আজকের লেখার বিষয়বস্তু হুগলির খানাকুলের রত্নাবলী কালীমন্দির। শিবপুরাণ অনুসারে এখানে মায়ের দক্ষিণ স্কন্ধ বা ডান কাঁধ পড়েছিল। রত্নাকর নদীর নামানুসারে মায়ের নাম হয়েছিল দেবী রত্নাবলী। এখানে দেবীর ভৈরব বা পীঠরক্ষক হলেন ঘন্টেশ্বর শিব, ভক্তরা যাকে ভালোবেসে ‘বাবা ঘন্টেশ্বর’ বলে ডাকেন। এই সতীপীঠ স্থানীয়ভাবে ‘আনন্দময়ী শক্তিপীঠ’ নামে পরিচিত।

পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে এখানে  দেবীকে 'কুমারী' হিসাবে পূজা করা হয়। মনে করা হয় মা এখানে খুবই জাগ্রত। দেবীর মন্দিরের কাছেই নদীর তীরে শ্মশান। এই শক্তিপীঠে সাধক রামপ্রসাদের গুরুদেব কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তন্ত্র সাধনা করতেন। মায়ের মূর্তি এখানে অনন্য সুন্দর।

মন্দিরের ইতিহাস আলোচনা করে জানা যায়, আগে এখানে বাবা ঘণ্টেশ্বর প্রতিষ্ঠিত হন, মা রত্নাবলী পরে আসেন। এপ্রসঙ্গে জনশ্রুতি রয়েছে যে অনেককাল আগে খানাকুলের কাছাকাছি এক গ্রামের বাসিন্দা বটুক কারকের বাড়িতে একটি গরু ছিল। সেই গরুটি বাড়িতে কখনও দুধ দিত না কিন্তু খানাকুলের এই অঞ্চলে একটি শিমূল গাছের পাশে এসে দুধ দিত।  প্রতিদিন এই ঘটনা ঘটতে দেখে বটুকবাবুর মন কৌতূহলী হয়ে ওঠে‌। একদিন তিনি শিমূল গাছের  পাশে ওই নির্দিষ্ট জায়গাটি চিহ্নিত করে সেখানে ভূমিতে খনন কাজ শুরু করেন। কিছুটা খোঁড়ার পরেই একটি শিবলিঙ্গ খুঁজে পেলেন তিনি। সেই শিবলিঙ্গটিই "ঘন্টেশ্বর শিব" রূপে প্রতিষ্ঠা করা হল।

আনুমানিক ৭১২ সালে খানাকুলে প্রতিষ্ঠিত হয় ঘন্টেশ্বর শিবমন্দির। তার দু'বছর পর অর্থাৎ ৭১৪ সালে ওই অঞ্চলে আসেন বর্ধমানের জমিদার বংশের সন্তান স্বরূপ নারায়ণ ব্রহ্মচারী। তিনি ধ্যানে বসে জানতে পারেন ওই অঞ্চলেই পড়েছে সতীর দক্ষিণ স্কন্ধ বা ডান কাঁধ। একদিন গভীর রাতে শিমূল গাছের পাশে যেখান থেকে বাবা ঘন্টেশ্বরকে পাওয়া গিয়েছিল সেই একই জায়গায় একটি আলোর রেখা দেখতে পেলেন স্বরূপ নারায়ণ।

এরপর সেই স্থানে গিয়ে একটি প্রস্তর খণ্ড পান তিনি। মনে করা হয় এটিই ছিল দেবী সতীর ডান কাঁধ। পাথরে পরিণত হওয়া সেই খণ্ডটি অর্থাৎ। সতীর দক্ষিণ স্কন্ধটি মঙ্গলঘটের নীচে রেখে এরপর মা কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন সাধক স্বরূপ নারায়ণ ব্রহ্মচারী। তখন থেকেই দেবীর পূজা হয়ে আসছে। আজও একইভাবে পূজিতা হন মা রত্নাবলী আনন্দময়ী। জানা যায় প্রতিষ্ঠার সময় এই মন্দিরটি ছিল একটি তালপাতার কুঁড়েঘর। বহু বছর পর বর্ধমানের মহারাজা এই পাকা মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন।

এখানে মাকে প্রত্যেকদিন মিষ্টি, ফল ও অন্নভোগ দিয়ে পুজো করা হয়। এই পীঠের কুণ্ডের জল খুব পবিত্র বলে ভক্তদের বিশ্বাস। বেলপাতার বদলে নারকেল দিয়ে এখানে ভৈরব ঘন্টেশ্বর মহাদেবের মানত করা হয়। প্রতি অমাবস্যায় এই মন্দিরে ঘটা করে পুজো হয়। রাজ্য এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এই শক্তিপীঠ দর্শন করতে এবং পুজো দিতে আসেন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বেশ কড়া নিয়মকানুন মেনে এখানে পুজো করা হয়। এখানকার রত্নাবলী মায়ের চার হাত। অমাবস্যা তিথিতে, দুর্গা পূজার সময় এবং নবরাত্রির সময় ভক্তদের ভিড়ও হয় চোখে পড়ার মতো। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম পবিত্র জায়গা এই সতীপীঠ।

এবারের শক্তিপীঠ পর্ব এই পর্যন্তই। পরবর্তী পর্বে নতুন আরেকটি সতীপীঠ নিয়ে লেখা আসবে। নতুন বছরের আগাম শুভেচ্ছা জানাই সব পাঠকবন্ধুদের।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...