বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ: কালীঘাট কালীমন্দিরের কথা

"বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ" সিরিজে আজ প্রথম শক্তিপীঠ নিয়ে এই লেখা। আর এই নিবন্ধ-লিখিয়ের যেহেতু কলকাতার কোলেই জন্ম, কর্ম সমস্ত কিছুই, সুতরাং শক্তিপীঠ বা সতীপীঠ নিয়ে লেখা শুরু করলে যেই মন্দির বা শক্তিপীঠের কথা প্রথম মনে পড়বে সেটি যে কলকাতারই হবে সে আর নতুন কি? আর কলকাতায় সতীপিঠ – মানেই কালীঘাটের কালীবাড়ি। হিন্দুশাস্ত্র বা পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, তেত্রিশ কোটি দেবদেবীদের মধ্যে সবচেয়ে জাগ্রত হলেন মা কালী। তাঁর কাছ থেকে ভক্তরা নাকি কখনই খালি হাতে ফেরে না।

তিনি সকল ভক্তের মনস্কামনা পূর্ণ করেন, তাদের বরাভয় প্রদান করেন। তাই, বিপদে আপদে মা কালীর কাছে ছুটে যান তাঁর অসংখ্য ভক্ত। কালীঘাটের মা কালীর মন্দির শুধু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের নয়, সারা ভারতের একটি অতি প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। তাহলে শুরু করা যাক "মহাতীর্থ শক্তিপীঠ কালীঘাট"।

 

KalighatTemple1

কলকাতা মহানগরীর অন্যতম দর্শনীয় স্থানের তালিকায় একেবারে প্রথম দিকে নাম থাকে কালীঘাট কালীমন্দিরের। প্রতিদিন বেশ কয়েক হাজার পুণ্যার্থী কালীঘাটে আসেন মায়ের দর্শন করতে এবং পুজো দিতে। বিশেষ বিশেষ দিনে যেমন প্রতি শনিবার এবং মঙ্গলবার, প্রতি অমাবস্যায়, দীপাবলির রাতে এই সংখ্যা বেড়ে কয়েক লক্ষে পৌঁছে যায়।

কালীঘাট - সতীর একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম এই পীঠস্থানে, পীঠমালা তন্ত্র অনুসারে, সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর ডান পায়ের চারটি (মতান্তরে একটি) আঙুল পতিত হয়েছিল। পুরাণে এই স্থানকে বারাণসী তুল্য পুণ্যস্থান বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

কথিত, এই কালীবাড়ির তিন প্রান্তে অবস্হান করেন স্বয়ং ব্রহ্মা , বিষ্ণু এবং মহেশ্বর আর তার মাঝেই রয়েছেন দেবী দক্ষিণা কালিকা। দশমহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা হলেন মা কালী যাঁকে আমরা দক্ষিণা কালী রূপে পূজা করি। দেবী এই পীঠস্থানে ভৈরবী  বগলা, মাতঙ্গী, বিদ্যা, কমলা, ব্রাহ্মী, মহেশ্বরী এবং চণ্ডী রূপে পূজিতা হন। এই পীঠস্থানে দেবীর আরাধনার বিশেষত্ব এইই যে কোনও পুজো উপলক্ষেই এখানে ঘট স্থাপনের নিয়ম নেই। কারণ, মা স্বয়ং এখানে বিরাজমানা। দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে এখানে দেবীকে মহালক্ষ্মী রূপে পূজা করা হয়। এর আর এক নাম শ্যামা লক্ষ্মীপুজো। কালীঘাটে দেবী কালীর ভৈরব হলেন মহাদেব নকুলেশ্বর। মাকালীর মন্দিরের উত্তর পূর্ব দিকে নকুলেশ মহাদেবের মন্দির রয়েছে।

 

KalighatTemple2

 

পীঠমালা তন্ত্রে যে শ্লোকটি রয়েছে তা হলো:
"যুগাদ্যায়ং মহাদেব দক্ষাঙ্গুষ্ঠং পদোমম
নকুলীশঃ কালীপীঠে দক্ষপদাঙ্গুলি সু চ মে
সর্বসিদ্ধিকারী দেবী কালিকা তত্র দেবতা।।"

বাংলায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায়: "কালীঘাট মহাশক্তিপীঠ। সকল পীঠস্থানের শ্রেষ্ঠ। কালীপীঠের দেবী মহাশক্তিস্বরূপিণী কালী। আর পীঠরক্ষক হলেন ভৈরব নকুলেশ্বর। এখানে পুজো দিলে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কালীঘাটের দেবী কালিকা সর্বসিদ্ধিকারী।
(কালীক্ষেত্র কালীঘাট; সুমন গুপ্ত)

কালীঘাট একটি বহু প্রাচীন তীর্থক্ষেত্র। কোনো কোনো ইতিহাসবিদদের মতে, "কালীঘাট" কথাটি থেকে "কলকাতা" নামটির উদ্ভব। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা "চণ্ডীমঙ্গল" কাব্যেও কালীঘাটের উল্লেখ রয়েছে।   চণ্ডীমঙ্গলে কবি বর্ণনা করেছেন ধনপতি সওদাগর তার পুত্র শ্রীমন্তকে নিয়ে সপ্তডিঙায় চড়ে আদিগঙ্গা দিয়ে যাবার সময় এখানে পূজা দিয়েছিলেন।
কবি লিখেছেন

"কালীঘাট এরাইল বেণীর নন্দন,
কালীঘাটে গিয়া ডিঙি দিল দর্শন।"
এখানে উল্লেখ্য যে এই কাব্য দ্বাদশ শতকে রচিত হয়েছিল।

জনশ্রুতি, বহু বহু বছর আগে আত্মারাম ব্রহ্মচারী নামক এক কালীভক্ত সাধক এইস্থানে দেবী কালীর ধ্যান করছিলেন। ধ্যানরত অবস্থায় একদা তিনি দেবীর কন্ঠে এক আদেশ শুনতে পেলেন। দেবী তাকে জানালেন, যে বেদীতে আত্মারাম বসে ধ্যান করছিলেন সেই বেদীটি ব্রহ্মবেদী (অর্থাৎ একদা ব্রহ্মা সেখানে বসে ধ্যান করতেন)। দেবী তাকে এই নির্দেশও দিয়েছিলেন যে, নীলগিরি পর্বতে ব্রহ্মানন্দ গিরি নামক একজন বিরাট সাধক রয়েছেন, তার কাছে একটি কষ্টিপাথরের শিলাস্তম্ভ রয়েছে, সেই শিলা যেন সেই ব্রহ্মবেদীতে দেবীমূর্তিরূপে স্থাপন করা হয়। এরপর আত্মারাম নীলগিরি গিয়ে ব্রহ্মানন্দের সাথে দেখা করেন। কোন দৈববলে সেই বারো হাত লম্বা ও দু হাত চওড়া শিলাকে কালীঘাটে আনা হয়েছিল সেটা অজানা।

 

KalighatTemple3

 

পুরাণ মতে, দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা স্বয়ং সেখানে আবির্ভূত হয়ে সেই শিলাকে মাতৃরূপ দেন এবং সেই মাতৃমূর্তি ব্রহ্মবেদীতে স্থাপন করেছিলেন। ধর্মীয় বিচার অনুযায়ী অসমের কামাখ্যা মন্দিরের ঠিক পরেই কালীঘাটের স্থান। শাস্ত্র অনুযায়ী, মহাকালী দেবী সতীর তমস রূপ। দশমহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা হলেন মা কালী। মা কালী হলেন আদ্যা মহাবিদ্যা-পরম ব্রহ্মময়ী । তন্ত্রসাধকদের মতে, কালী মায়ের ভয়ঙ্কর রূপের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলির অন্যতম হলো কালীঘাটের দেবী দক্ষিণা কালিকা।

একসময় এখানে রোজ ছাগবলি হত। কিন্তু এখন আর তা হয় না। শোনা যায়, এই মন্দিরে কেবল ভক্তজন বা রাজা জমিদাররাই পুজো দিয়েছেন তার নয়, এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন ইংরেজ সাহেবরাও। একটি মামলা জেতার জন্য একবার নাকি মানত করে গিয়েছিলেন একজন সাহেব। সেই মামলা জিতেওছিলেন তিনি। জেতার পর কালীবাড়ি এসে তখনকার সময়ে তিন হাজার টাকার পুজো দিয়েছিলেন তিনি। পঞ্জাব ও বার্মা দখলের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকেও নাকি কালিঘাট মন্দিরে ষোড়শ উপাচারে পুজো দেওয়া হয়েছিল।

কালী মন্দিরের সামনেই রয়েছে একটি পুকুর যার নাম কালীকুণ্ড। কিংবদন্তি রয়েছে যে এই পুকুরেই দেবী সতীর পায়ের প্রস্তরীভূত আঙ্গুল পাওয়া গিয়েছিল। কালীঘাট কালীমন্দিরের কষ্টিপাথরের দেবীমূর্তিটি অভিনব ধরণে নির্মিত। দেবীমায়ের জিভ, দাঁত ও মুকুট সোনার। হাত ও মুণ্ডমালাটিও সোনার। মন্দিরে মধ্যে একটি সিন্দুকে দেবীর প্রস্তরীভূত অঙ্গটি রাখা আছে। কারোর সামনে এটি বের করা হয় না।

 

KalighatTemple4

 

বহু মানুষ এই মন্দিরে অনেক দানধ্যান করেছেন। ১৭৬৫ সালে  রাজা নবকৃষ্ণ দেব মা'কে সোনার মুণ্ডমালা দান করেছিলেন। সঙ্গে দান করেছিলেন লক্ষাধিক টাকাও। খিদিরপুরের গোকুলচন্দ্র ঘোষাল কালী মায়ের চার হাত রূপায় তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই হাত পরে সোনার বানিয়ে দিয়েছিলেন কালীচরণ মল্লিক। দেবীর সোনার জিভ গড়িয়ে দিয়েছিলেন পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ। পাতিয়ালার মহারাজও সোনার মুণ্ডমালা দান করেন। দেবীর মাথার রূপার ছাতা গড়িয়ে ছিলেন নেপালের সেনাপতি জঙ্গ বাহাদুর।

বর্তমান মন্দিরের বয়স ২০০ ছাড়িয়েছে। শোনা যায়, আরও অতীতে যশোহররাজ প্রতাপাদিত্যর কাকা রাজা বসন্ত রায় আদিগঙ্গার তীরে মাকালীর একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন কিন্তু কালের প্রভাবে সেটি লুপ্ত। দুশো বছর আগে প্রজাদের মঙ্গল কামনায় বড়িশার জমিদার শিবদেব রায়চৌধুরী নতুন মন্দির নির্মাণে হাত দেন। কিন্তু মন্দির শেষ হওয়ার আগেই তিনি পরলোকগমন করেছিলেন। এই মন্দির সম্পূর্ণ হয় তাঁর পুত্র রামলাল ও ভাইপো লক্ষ্মীকান্তর হাতে। আটচালা এই মন্দিরে পরবর্তী কালে দফায় দফায় সংস্কার হয়েছে।

কালীঘাট আজ শুধু ভারত-বিখ্যাত তীর্থস্থান নয়, এই শক্তিপীঠ এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি মন্দির এবং দর্শনীয় স্থান। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের শীর্ষ স্তরের মানুষজন, বলিউডের সেলিব্রিটি বা রাজনীতিবিদ, সকল শ্রেণীর ভক্ত মানুষ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন এই তীর্থস্থানে দেবী কালীর দর্শন করতে এবং পুজো দিতে। তিনি যে মা আর মা যে তাঁর সন্তানদের মঙ্গল করবেনই।

জিয়ো বাংলার পাঠক বন্ধুদের কেমন লাগছে এই শক্তিপীঠ-কথা? আজকের নিবন্ধ এখানে শেষ করা যাক। পরের সপ্তাহে আসব নতুন পীঠস্থান নিয়ে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...