বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ: সতীপীঠ ফুল্লরার থান

"বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ" সিরিজের চতুর্থ পর্বে আমরা যাব বীরভূম জেলার লাভপুরে সতীপীঠ ফুল্লরার থানে। এখানে একটি তথ্য জানানো যাক। বাংলার চৌদ্দটি শক্তিপীঠের মধ্যে পাঁচটি সতীপীঠই রয়েছে বীরভূম জেলায়। শক্তিসাধনার পীঠভূমি বীরভূম। বীরভূমকে দেবী কালীর চারণভূমিও বলা যেতে পারে। প্রাচীন কাল থেকেই এই জেলায় শাক্ত ধর্মের প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে চৈতন্য মহাপ্রভুর সময়েও বীরভূমের শক্তি আরাধনাকারী বীরাচারী তান্ত্রিক সাধুরা দেবী গৌরীকে ছেড়ে গৌর-অনুগামী হননি।

চৈতন্যলীলা কীর্তন রচনাকার বৃন্দাবন দাসের লেখায় বীরভূম সম্পর্কে মহাপ্রভুর মুখ দিয়ে সেখানে বলানো হয়েছে, "ভক্তিশূন্য সর্ব্বদেশ না জানে কীর্তন, কারো মুখে নাহি কৃষ্ণনাম উচ্চারণ।" বীরভূমে জন্মগ্রহণ করে বৈষ্ণব প্রভু নিত্যানন্দ নিজে ভক্তিরসের জোয়ারে ভাসলেও শাক্তদের ভাসাতে পারেননি। লাল মাটির পীঠস্থানগুলিতে বরাবর শক্তির পূজারীদের প্রাধান্য ছিল।

 

FullaraDevi1

পুরাণ অনুসারে একান্ন পীঠের ৪৯তম পীঠ লাভপুরের দেবী ফুল্লরা পীঠ। দেবীপুরাণ অনুযায়ী, সতীর অধরোষ্ঠ পড়েছিল এখানে। এখনও এই মন্দির চত্বরে পঞ্চমুন্ডির আসন  রয়েছে। ৬৬ বিঘা জমি নিয়ে এই ফুল্লরা মহাপীঠ। মাতৃমন্দিরটি কিন্তু  বিশেষ প্রাচীন নয়, সংস্কারের ছোঁয়া পেয়ে নতুন করে গড়ে উঠেছে। ১৩০২ বঙ্গাব্দে স্থানীয় জমিদার যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। চারদিক গাছপালায় ঘেরা ছায়াময় পরিবেশে  মা ফুল্লরার মন্দির।

শক্তিপীঠ ফুল্লরা অট্টহাস নামেও পরিচিত। বীরভূমের প্রাচীন এই দেবীপীঠ এক সময় তান্ত্রিকদের সাধনাক্ষেত্র ছিল। পীঠচূড়ামনি অনুসারে, ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা খণ্ডিত দেবী সতীর দেহাংশগুলি যখন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় পড়েছিল তখন দেবীর নিচের ঠোঁটটি পড়েছিল এই লাভপুরে। এই পীঠ জনবসতি থেকে কিছুটা দূরে এক ছোট্ট লাল কাঁকুরে মাটির টিলার উপর অবস্থিত। টিলার নীচে বয়ে চলেছে উত্তর অভিমুখী কোপাই নদী। এই মন্দিরে কোনো দেবীমূর্তি নেই। সিঁদু্র মাখানো কচ্ছপাকৃতি একটি লোহিত বর্ণ শিলাখণ্ডকেই দেবীর প্রতিভূ রূপে পূজা করা হয়

 

FullaraDevi2

 

এই মন্দিরের পাশে একটি বিরাট পুকুর আছে। কিংবদন্তি অনুসারে, রামের দুর্গাপূজার সময় হনুমান এই পুকুর থেকেই ১০৮টি পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন। এই জলাশয়ের নাম দেবীদহ বা দলদলি। প্রবাদ আছে, এই দিঘির জল নাকি কোনও দিন শুকোয় না। মন্দিরের কাছেই শ্মশান। তন্ত্র সাধনার উত্তম স্থান হিসেবে প্রসিদ্ধ ফুল্লরায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে তন্ত্রসাধকরা আশ্রয় নিয়েছেন। আগে এই মন্দিরে নিয়মিত শিবাভোগের অর্থাৎ শিয়ালকে ভোগ দেওয়ার নিয়ম ছিল। এখানে প্রতিদিনের দেবীর ভোগের একটি আবশ্যিক পদ হলো মাছের টক।

এবার ফুল্লরা সতীপীঠের ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। দেবী ফুল্লরার মন্দির প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন কৃষ্ণানন্দ/কৃষ্ণদয়াল গিরি নামের এক সাধক সন্ন্যাসী। তিনি বারাণসী ধামে মণিকর্ণিকা ঘাটের কাছে থাকতেন। একদিন তিনি স্বপ্নে দেবীর দর্শন পান। দেবী মা তাকে আদেশ দেন এই লাভপুরে এসে দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

 

FullaraDevi3

 

তিনি বহু বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে পৌঁছে দেবী সতীর ওষ্ঠরূপী শিলাখণ্ডটি আবিষ্কার করে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে ফুল্লরা মায়ের পূজার্চনা শুরু করেন। ভালো করে দেখলে শিলাটির সামনের দিকটা ঠোঁটের মতো মনে হয়। একসময় নাকি মন্দিরের চূড়ায় স্বর্ণকলস শোভা পেত। এখানে দেবীর ভৈরব বিশ্বেশ্বর মহাদেব। দেব বিশ্বেশ ফুল্লরা মন্দিরের কাছেই পীঠ চত্বরে আলাদা একটি ছোট মন্দিরে অবস্থান করছেন। মাঘী পূর্ণিমায় এই শক্তিধামে বিশেষ যাগযজ্ঞ সহ মায়ের পূজা এবং উৎসব হয়ে থাকে।

এই লাভপুরেই প্রথম বাঙালি জ্ঞানপীঠজয়ী সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। এখানেই তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় সাহিত্যকর্মে কাটিয়েছেন। ফুল্লরা মন্দিরের কাছেই রয়েছে তাঁর জন্মভিটে। দেবী ফুল্লরার মাহাত্ম্য বর্ণনা করার জন্য একটি ছোট কাহিনী বলা যাক।

বিয়ের পর বেশ কয়েক বছর সন্তান না হওয়ায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা শ্রীরামজি গোঁসাই নামে এক তন্ত্রসাধকের কাছে গিয়েছিলেন। সেই সাধুর নির্দেশে, দুর্গাপুজোর পরের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে তারাপীঠে পুজো দিয়ে তিনি দেবী ফুল্লরার কাছে ব্রত উদযাপন করেন। এরপরই তিনি সন্তানসম্ভবা হন এবং এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। মা তারার নামে সেই সন্তানের নাম রাখা হয়েছিল তারাশঙ্কর। ভক্তদের বিশ্বাস মা ফুল্লরা তাঁর সন্তানদের কখনও খালি হাতে ফেরান না। ভক্তি, বিশ্বাস এবং বৈচিত্র্যের লীলাভূমি এই ফুল্লরা সতীপীঠ।

আমার জিয়ো বাংলার পাঠক বন্ধুরা, সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। পরের সপ্তাহে আসছি নতুন পর্ব নিয়ে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...