বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ: সতীপীঠ অট্টহাস

বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ সিরিজের একেবারে শেষ দিকে চলে এসেছি আমরা। এবারের পর্বে আমাদের অতিথি রূপে আছেন ‘দেবী অট্টহাস’। সম্ভবতঃ ওষ্ঠ শব্দটির অপভ্রংশ "অট্ট"। প্রাচীন কুব্জিকা তন্ত্র গ্রন্থে "দেবী অট্টহাস" এর উল্লেখ আছে। পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে রয়েছে এই সতীপীঠ। কথিত রয়েছে এখানে দেবী সতীর নিচের ঠোঁট পতিত হয়েছিল। সেই থেকেই সম্ভবতঃ নাম হয় অট্টহাস।

যে সব জায়গায় সতীর দেহাংশ পড়েছিল, সেগুলিই এক-একটি সতীপীঠ রূপে পরিচিতি লাভ করে। হিন্দু ভক্তজন এই সতীপীঠ গুলিকে অতি পুণ্যভূমি বলে বিবেচনা করে থাকেন।

পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম দক্ষিণডিহি গ্রামের উত্তর বাহিনী নদী ঈশানীর তীরে প্রায় ২৭ বিঘা ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই সতীপীঠটি অবস্থিত। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য এখানে অতি মনোরম। চেনা অচেনা নানান গাছে রংবেরঙের প্রজাপতি, ফড়িং, কত রকমের পাখি, শিয়ালের ডাক— মন ভালো করে দেবেই। এই অট্টহাস মন্দির অন্ততঃ তিনশো বছরের প্রাচীন। সেই কারণে এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ইতিহাস। কিংবদন্তি জানাচ্ছে—বহুকাল আগে এই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। মাঝে মাঝে দু-একটি চাষের ক্ষেত থাকলেও দিনের বেলায় ও ছিল গা ছমছমে পরিবেশ।জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে বয়ে যেত ঈশানী নদী। নদীর তীরে শ্মশান। মাঝে মাঝে ভেসে আসত শেয়ালের ডাক, বনবিড়ালের ডাক। বর্ষায় ঈশানীর বন্যায় ভেসে যেত মাঠ, চাষের জমি। গ্রামে যে ক'ঘর কৃষকের বাস ছিল তাদের দুর্দশার অন্ত ছিল না। সেরকমই এক সময়ে কয়েকজন কৃষকের চোখে পড়ল যে দীর্ঘদেহী এক জটাধারী সন্ন্যাসী ওই গভীর জঙ্গলে আসা-যাওয়া করা শুরু করেছেন।

এক বছর প্রবল বন্যায় যখন মাঠঘাট, ধানজমি সব ভেসে গেছে , চাষীদের মাথায় হাত তখন শরতের দুর্গা পূজার মহাষষ্ঠীর উষালগ্নে হঠাৎ সেই সন্ন্যাসীর দর্শন পায় গ্রামবাসীরা। চোখের জলে ভেসে তাদের দুর্দশার কথা শোনাল তাঁকে যদি তাদের দুর্দশার কোনও সুরাহা হয়। সব শুনে সন্ন্যাসী তাদের বললেন, 'তোমরা অতি ভাগ্যবান কারণ এই স্থান শক্তিপীঠ। এখানে তোমরা জন্মেছ, দেবীর কৃপাতেই তোমাদের দুঃখ ঘুচবে।' এই বলে তিনি জঙ্গলের মধ্যে একটি স্থান নির্দেশ করে বললেন যে ঐ স্থানে তিনি যজ্ঞ করবেন। গ্রামবাসীরা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে সেখানে তৈরি করে ফেললেন যজ্ঞকুণ্ড। দিনের শেষে সন্ন্যাসী বসলেন আসনে, সারারাত ধরে যাগযজ্ঞ চলল। পরদিন সপ্তমীর ভোরে সূর্যোদয়ের আগে বায়ুকোণে একটি বিশাল পাথর রেখে তার ওপর ঘট স্থাপন করে তিনি মায়ের পুজোর সূচনা করলেন। গ্রামবাসীদের জানালেন, এই স্থান হল সতীপীঠ। দেবী সতীর নীচের ঠোঁট বা অধর পড়েছে এখানে। জয়দুর্গা মন্ত্রে নিত্যসেবা করতে হবে এই দেবী অট্টহাস বা অধরেশ্বরীর। প্রতি বছর দুর্গা সপ্তমীর দিন যেন দেবীর ঘট পাল্টানো হয়। এই নির্দেশ দিয়ে আচমকা অন্তর্ধান করলেন সেই সন্ন্যাসী। সেই থেকে এই স্থানে স্থাপিত হলেন মা অট্টেশ্বরী বা অট্টহাস। শুরু হল দেবীর পুজো। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল অট্টহাসের নাম। অধঃওষ্ঠ বা দেবী সতীর নীচের ঠোঁট পড়েছিল বলে জায়গার নাম হল অট্টহাস কারণ ওষ্ঠ হাসির প্রতীক। মন্দিরের কাছেই অবস্থান করছেন পীঠ ভৈরব বিল্বেশ বা বিল্বেশ্বর।

Satipith_Attahas 

 দেবী এখানে চামুণ্ডা রূপে পূজিতা হয়ে আসছেন। যুগ যুগ ধরে তন্ত্রসাধকেরা এখানে এসে, পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে দশ মহাবিদ‍্যারূপী মহামায়ার সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছেন। শান্ত পরিবেশে ভক্তি ভরে পুজো দেওয়া যায় এই শক্তিপীঠে। কিংবদন্তি, একমনে মাকে ডাকলে আজও দেবীর উপস্থিতি অনুভব করা যায় এখানে। মায়ের প্রধান শিলা এখন ভূগর্ভের কয়েক হাত নিচে চলে গেছে। এই মন্দিরের উত্তরে ঈশাণী নদী ও কিছুটা দূরে শ্মশান।

অট্টহাসে দেবীর মূল মূর্তিটি দেবীর অষ্টচামুণ্ডা রূপের অন্যতম দন্তুরা চামুণ্ডা। এই মূর্তি ভারতবর্ষে সচরাচর দেখা যায় না। মূর্তির বয়স সাড়ে তিন হাজার বছরেরও বেশি। দেবীর আসল মূর্তিটির দর্শন মানুষের মনে ভয়ের উদ্রেক করে। কঙ্কালসার চেহারায় ফুটে উঠেছে বুকের পাঁজর। দুটি কান শরীরের তুলনায় বেশ বড়। বৃহৎ গোলাকার চোখ। খোলা চুল পিঠের উপর পড়েছে। মুখের দু’পাশ  থেকে বেরিয়ে রয়েছে কুকুরের মতো দুটি তীক্ষ্ণ দাঁত। হিংস্রতার ছাপ দেবীর সারা মুখে। বাঁ হাতে মাটিতে ভর দিয়ে আর ডান হাত হাঁটুতে রেখে দেবী অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে আছেন। পাথরের উপর খোদাই করা হয়েছে এই সোওয়া এক ফুটের দন্তুরা চামুণ্ডার মূর্তি। এই মূর্তি বর্তমানে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর সংগ্রহশালায় রয়েছে। মূল মূর্তির একটি ছবি রয়েছে অট্টহাস মন্দিরে।

খেড়ুয়ার জমিদার দেবীদাস চট্টোপাধ্যায় এখানে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাকা মন্দির ও রান্নাঘর নির্মাণ করিয়ে দেন। মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে গেলে ১৩৪০ সালে খাটুন্দির কালীপদ চট্টোপাধ্যায় মন্দিরটি সংস্কার করিয়ে দেন। মন্দিরের পশ্চিমে এক বিশাল বটবৃক্ষের তলায় রয়েছে একটি ছোট মন্দির। এই মন্দিরে ভৈরব বিল্বনাথের ছোট শিবলিঙ্গ থাকলেও আসল বিল্বনাথের মন্দির রয়েছে নিকটবর্তী বিল্বেশ্বর গ্রামে।

মন্দিরে সারাবছরই ভক্তদের যাওয়া-আসা লেগে থাকে । প্রতি অমাবস্যায় মায়ের পুজো হয় এবং প্রায় দু থেকে তিনশো মানুষ মায়ের ভোগপ্রসাদ পান। ভক্তের ঢল নামে দীপাবলীর সময়। যুগ যুগ ধরে এই পীঠে অবস্থান করে দেবী রক্ষা করে চলেছেন তাঁর ভক্তকূলকে।

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...