"আজ সক্কাল সক্কাল রান্না সেরে নিতে হবে"...
"না না গ্ৰহণের মধ্যে কিছু খাওয়া? অসম্ভব"..
"না বাবা, গ্ৰহণের সময় বাড়ি থেকে কোথাও বেরোব না।"
"পুজো দেওয়া তো বারণ সূর্য গ্ৰহণের মধ্যে জানো না বুঝি?"...
"আসলে জানি এসব না মানলেও চলে তবুও... এতদিন মা ঠাকুমারা যা বলে এসেছেন সবই কি ভুল?"..
উপরের এই মন্তব্যগুলো যে বিষয়ের উপর বা যে ঘটনার উপর করা হয়েছে সেটা হলো সূর্যগ্ৰহণ যার ইংরেজি প্রতিশব্দ সোলার ইক্লিপস। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে যেমন সকাল হয়, আকাশে সূর্য ওঠে, দুপুরে মাঝ আকাশে থেকে চারিদিক ঝলসে দেয়, আবার সন্ধ্যায় গুটি গুটি পায়ে পশ্চিম আকাশে অস্ত যায় অথবা গ্ৰীষ্মের পরে আসে বর্ষা, বর্ষার পর শরৎ - মানে এগুলো যেমন স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা, ঠিক সেরকমই সূর্যগ্ৰহণ একটা প্রাকৃতিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। নিজের নিজের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে চাঁদ এমনভাবে সূর্য আর পৃথিবীর মাঝখানে চলে আসে যে সূর্য পৃথিবীর কিছু অংশ থেকে কিছু সময়ের জন্য দেখা যায় না। একটি অনন্য অনবদ্য মহাজাগতিক কিন্তু স্বাভাবিক ঘটনা এটা।
অথচ আমরা কী করছি? বহুদিন আগে একটা কোন গল্পে পড়েছিলাম একজন সাদা চামড়ার মানুষ টাইম মেশিনে পিছিয়ে গিয়ে আদিম যুগে পৌঁছে আদিবাসীদের হাতে ধরা পড়ে। আদিবাসীরা তাকে মেরে ফেলবে বলে ঠিক করে। তখন তার মনে পড়ে যে সেদিন সূর্যগ্রহণ হবে। আদিবাসীরা তাকে যখন আগুনে পোড়াতে যাচ্ছিল তখন সে সূর্যের দিকে হাত নেড়ে বলে নিভে যা। তারপরই গ্রহণ শুরু। আদিবাসীরা ভাবতে শুরু করে সে ভগবান।
আজকের দিনেও কি আমরা সেই মানসিকতা থেকে বেরোতে পেরেছি? এই দু হাজার কুড়ি খ্রীষ্টাব্দেও বহু আধুনিক, শিক্ষিত মানুষও বিশ্বাস করে যে সূর্যগ্ৰহণের সময় রান্না, খাওয়া, স্নান, ঠাকুরপুজো এমনকী বাথরুমে যাওয়াও নাকি অতি অশুভ। উপরের মন্তব্যগুলো যাদের তারা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত। এমন খবরও রটেছে যে এই গ্ৰহণে যে মহাজাগতিক পরিবর্তন ঘটবে তাতে করোনা ভাইরাস নাকি নির্মূল হয়ে যাবে।
আসলে পুঁথিগত বিদ্যায় আমরা যতোই শিক্ষিত হই না কেন ধর্ম বা সংস্কারের একটা চাদর বা আস্তরণ আমাদের যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেচনা ইত্যাদি অনুভব বা বোধকে ঢেকে রাখে। আর আমরাও বোধহয় কুসংস্কার মানতেই ভালোবাসি। তাই "এই সূর্যগ্ৰহণ দেখলে কী কী ক্ষতি হতে পারে" বা "রাহু, কেতু ইত্যাদি (না দেখা কাল্পনিক জিনিসপত্রের) উপরে গ্ৰহণের প্রভাব কী"... এইধরনের ভিডিও হাজার হাজার মানুষ দ্যাখেন। অথচ একটাই মাত্র নিষেধাজ্ঞা মানা উচিত সেটা হলো খালি চোখে কখনোই সূর্যগ্ৰহণ দেখা উচিত নয়। চোখের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
তবে এর পরেও একটা আশার আলো অন্ধকার ভেদ করেই বেরিয়ে আসে। আমাদের স্বল্পশিক্ষিত পরিচারিকাটিকে আজ জিজ্ঞেস করলাম "কীরে, আজ তো গ্ৰহণ, তো তুই রান্না বান্না করে খাবি তো?" সে শুনে বললো "কী যে বলো দিদি! 'গেরোন' তো আকাশে হচ্ছে। এখেনে তার কী? খাওয়ার সঙ্গে তার কী সম্পক্ক??"
এই কথাগুলো যদি সবাই বুঝতো!!