এই ঠাকুর নাকি অতিথি-দেবতা। রাজবংশী ভাষায় এই দেবতার নামের মানে আত্মীয়। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির ব্যাংকান্দি গ্রাম। এখানেই রয়েছেন এক দেবতা। এই দেবতার আসল বাড়ি এই গ্রামে নয়। কথিত আছে এই গ্রামে এক ব্যক্তি নাকি বাইরে থেকে সোদর খেতে এসেছিলেন। অর্থাৎ বাইরে থেকে কোন আত্মীয় যখন কারোর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করতে আসেন, উত্তরবঙ্গের লৌকিক ভাষায় তাকে বলে সোদর খাওয়া। সেই ব্যক্তি নাকি আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে এসে আর কোনদিন ফিরে যাননি। স্থানীয় গ্রামবাসীরা এই গ্রামেই তার পাকাপাকি থাকার বন্দোবস্ত করে দেয়। তার জন্য থান বানিয়ে দেয় গ্রামবাসীরা। শুরু হয় সেই অতিথি দেবতার পুজো। রাজবংশী ভাষায় এই দেবতার নাম সুদর্শন। এই সোদর খইয়ের থান রয়েছে ময়নাগুড়ির ব্যাংককান্দি গ্রামে।
এই দেবতার আলাদা কোন মূর্তি বা প্রতীকী কোন পাথর খণ্ড নেই। কেবল একটি পরিতক্ত স্থাপত্যের ভগ্নাংশ রয়েছে। চারপাশে ইতিউতি ঝোপঝাড়। দুপাশে বড় বড় পাথরের ব্লক। তার সামনে ঢালু জায়গায় রাখা রয়েছে দুটি পিলারের ভগ্নাংশ। সেখানে দুদিকে দুটো প্রতিকৃতি খোদাই করা রয়েছে। গ্রামবাসীরা বলেন এই পিলারের গায়ে একসময় লিপি খোদাই করা ছিল। কিন্তু বর্তমানে সবকিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। পাথরের ব্লকের মাঝখান দিয়ে ঢালু হয়ে নেমে গেছে পাথর কেটে বানানোর সিঁড়ি। সেটা দিয়ে নীচে নামলে একটি চৌকো ঘর দেখতে পাওয়া যায়। এই ব্লকগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা ঢালাই করা এবং সুন্দর করে সাজানো। শোনা যায় সোদর-খৈ দেবতার জন্য একটি মন্দির তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবতাকে পুজো দেওয়া হতো।
স্থানীয় কেউ কেউ বলেন এটি আসলে একটি স্থাপত্যের ভগ্নাংশ যাকে সোদর খৈ দেবতা রূপে পূজা করা হয়।। কেউ বলেন এই স্থানীয় মন্দিরটিতে একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে নাকি মানুষ অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে।
স্থানীয় কেউ কেউ আবার বিশ্বাস করেন এই সুড়ঙ্গের সঙ্গে নাকি এটি শিব মন্দিরের যোগাযোগ রয়েছে। এক সময় লৌকিক দেবতা সোদর-খৈয়ের থানে স্থানীয় মানুষেরা আসতেন শিবের নামে জল বা দুধ ঢালতে। শিব ঠাকুরের থান বলে পুজো করেন। ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রির সময় এখানে স্থানীয়রা ভগবান শিবকে উদ্দেশ্য করে জল ঢালেন। তাদের বিশ্বাস এখানে জল ঢাললে সেই জল গিয়ে পড়বে জল্পেশে শিবের মাথায়। এছাড়াও স্থানীয়রা এই সুড়ঙ্গে খুচরো পয়সা ফেলে মানত করেন। সোদর-খৈয়ের মূল পুজো হয় চৈত্র মাসে। স্থানীয় রাজবংশী দেউসী থাকেন পুজোর জন্য। আগে এই পুজোয় দেউসীর ভর উঠতো। বাঁধা ধরা এই দেউসী নাকি ভর উঠলে মানুষের জিজ্ঞেস করা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতেন। তবে বর্তমানে এমনকিছুর খোঁজ পাওয়া যায় না।
খুব সামান্য উপকরণেই সোদর-খৈ ঠাকুরের পুজো করা হয়। দুধ, আটিয়া কলা এবং চিড়ে দিয়ে পুজো করা হয়। এছাড়া তৈরি করা হয় পায়েস। পুজোর পর ভক্তদের দই-চূড়া প্রসাদ হিসেবে খেতে দেওয়া হয়। এই পুজো ঘিরে প্রতিবছর এখানে ছোটখাটো মেলা বসে। বহু বছর আগেই এই অঞ্চলের মানুষরা এই থানের সামনে কালী মন্দির এবং শিবের থান তৈরি করে দিয়েছেন। ঐতিহাসিকরাও এমনটাই বিশ্বাস করেন যে প্রাচীন কোন স্থাপত্যের অংশ এই সোদর-খৈ ঠাকুরের থান। পরবর্তীকালে সেটা লৌকিক দেবতা হিসেবে পুজিত হতে হতে শিব ভক্তির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তবে এই সোদর খইয়ের থান ওই অঞ্চলের একেবারে আপন জনের মতো।