দেবদেবীদের মধ্যে হতভাগিনী যদি কেউ থেকে থাকেন, তবে তিনি হলেন, দেবী মনসা। কেন? কেননা, তাঁর জন্মই হল নিকৃষ্ট কামনা থেকে। মহাদেব পুকুরে স্নান করতে গিয়ে চখাচখির যৌনাচার দেখে কামনাতাড়িত হলেন। জন্মবীজ স্খলিত হতে চাইল। মহাদেব তা স্খলন করলেন পুকুরের পদ্মপাতায়। তখন পদ্মের নাল বেয়ে সেই বীজ পাতালের নাগলোকে গিয়ে পৌঁছল। নাগরাজ তা থেকে নির্মাণ করলেন সুন্দরী কন্যা মনসাকে। পদ্মনাল বেয়ে জন্মবীজ পেয়েছিলেন বলে কন্যার নাম দিলেন, পদ্মা বা পদ্মিনী। মাতৃগর্ভ থেকে জন্মের সৌভাগ্য তাঁর হল না। সে না-হয় তাঁর দুই বৈমাত্রেয় ভাই কার্তিক-গণেশেরও হয়নি। কিন্তু, বাল্যে বাপমায়ের সান্নিধ্য তো তাঁরা পেয়েছেন, ভালোবাসা পেয়েছেন, শিক্ষা পেয়েছেন, আদরে-আবদারে প্রশ্রয় পেয়েছেন--মনসার ভাগ্যে সেসবের কিছুই জুটল না।
মনসা বড় হতে লাগলেন শীতল রক্ত ও ক্রুর স্বভাবের বিষধর সাপেদের মধ্যে। ফলে, ধৈর্য্য-স্থৈর্য্য-ক্ষমার মতো সুকুমার বৃত্তিগুলো তাঁর স্বভাবে ফুটে উঠবার অবসর পেল না। যৌবনে তিনি পদ্মের লালিত্যে অপরূপ সৌন্দর্য পেলেন, কিন্তু, স্বভাবের জিঘাংসা তাঁর সমস্ত সৌন্দর্য ঢেকে দিল। যুবতী পদ্মা পিতার সন্ধানে মর্ত্যে যখন উঠে এলেন, তখনই পিতার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। কিন্তু, এমনই দুর্ভাগ্য যে, পিতা কন্যাকে চিনতে পারলেন না এবং কামদৃষ্টিতে দেখলেন! তারপর অবশ্য কন্যার প্রকৃত পরিচয় পেয়ে শিব লজ্জিত হলেন। কিন্তু, সম্পর্কের যে অবমাননা তিনি করলেন, নারীত্বের যে অবমূল্যায়ন তিনি করলেন, মেয়ে মনসাকে যে অপমান তিনি করলেন--তা কি তাতে মুছে গেল?
যাইহোক, শেষমেশ মেয়ের সঙ্গে পরিচয়পর্বের পর মহাদেব তাঁকে নিয়ে এলেন ঘরে। নেশাভাঙ না-করলে তিনি এক জায়গায় থাকার লোক নন, তাই মনসাকে ঘরে রেখে তিনি বেরিয়ে গেলেন। স্ত্রী চণ্ডী ঘরে ছিলেন না তখন। খানিক পরে ফিরে এলেন এবং ঘরে সুন্দরী মনসাকে একাকী বসে থাকতে দেখেই সটান সতীন ভেবে ফেললেন। কারণ, স্বামীর ছোঁকছোঁক স্বভাব যে কতটা প্রবল, এ তিনি হাড়ে হাড়ে জানেন! কাজেই সরাসরি চণ্ডী চণ্ডমূর্তি ধরলেন। শুরু করলেন গুষ্টিউদ্ধার পর্ব। কোথাও কিছু নেই খামোখা গালাগাল শুনে মনসারও মাথাগরম হয়ে গেল। ব্যস, শুরু হল ঝগড়া। এবং, সেটা গালাগালি থেকে চুলোচুলিতে উঠতে বেশি সময় লাগল না। মনসার সঙ্গে চণ্ডী ঠিক পেরে উঠলেন না, তাতে তাঁর রাগ আরও বাড়ল এবং জ্ঞানগম্যি হারিয়ে হাতের কাছে একটা শলাকা পেয়ে তা দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন মনসার চোখে। সেই আঘাতেই মনসার একটি চোখ সারাজীবনের জন্য নষ্ট হয়ে গেল! রক্তাক্ত মনসা চণ্ডীকে ছেড়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। চণ্ডীর ক্রোধ তাতেও শান্ত হল না। তিনি আরও আঘাত করতে উদ্যত হলেন, ঠিক সেই সময়ে রণস্থলে হাজির হলেন মহাদেব। চণ্ডীকে থামালেন কোনরকমে। তারপর মনসাকে শুশ্রূষা করে তুলে বসালেন। চণ্ডীকে জানালেন মনসার জন্মবৃত্তান্ত ও প্রকৃত পরিচয়। অনুরোধ করলেন কন্যা হিসেবে মনসাকে গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু, ক্ষুব্ধ চণ্ডী সহজ হতে পারলেন না, তিনি স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন--যে মেয়ের সঙ্গে গর্ভের সম্পর্ক নেই, রক্তের সম্পর্ক নেই--তাকে কন্যা হিসেবে মেনে নেওয়া তো দূরের কথা, ঘরেও তার জায়গা হবে না। ওকে নিয়ে মহাদেব যেন এক্ষুনি তাঁর চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যান!
মনসা পাতাললোক ছেড়ে এসেছেন, বাপের বাড়িতেও তাঁর ঠাঁই হল না, তিনি দেবীত্ব অর্জন করেননি, তাই স্বর্গেও তাঁর স্থান নেই। মহাদেবের সামর্থ্য নেই চণ্ডীর মুখের ওপর কিছু বলার। তাই মেয়েকে নিয়ে গেলেন অনেক দূরের এক নির্জন পর্বতে। সিজুয়া পর্বত। কাঁটা গাছ আর সাপসঙ্কুল সেই পর্বত। সেখানেই মেয়ের জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করে তাঁকে যেন নির্বাসন দিলেন মহাদেব। শুধু সঙ্গিনী হিসেবে রেখে এলেন 'নেতা' নামে তাঁর ঘর্মজাত আর এক কন্যাকে। শুরু হল মনসার গ্লানিময় নির্বাসিত জীবন। তবে, এতবড় অন্যায় ও বঞ্চনার পর মহাদেবেরও বোধহয় অনুশোচনা হয়ে থাকবে, তাই চেষ্টা করলেন মেয়েকে সংসারসুখী করে প্রায়শ্চিত্ত করতে। জরৎকারু নামের এক দারুণ নিষ্ঠাবান মুনি ছিলেন। তাঁকে রাজি করিয়ে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিন্তু, তাতে সুখ কি এলো মনসার জীবনে? না, এলো না।
সংসার হল। তবে, অল্পদিনের জন্য। সুখ যে অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী সেটা মনসা জীবন দিয়ে প্রমাণ করলেন। আসলে, তিনি সুখ কিনেছিলেন শর্তের বিনিময়ে। জরৎকারুর আদেশের অবাধ্য কখনও হবেন না--এই ছিল শর্ত। নিজেকেই নিজে গড়ে তোলা একটি মেয়ের পক্ষে এ শর্ত মানা খুবই কঠিন। এ তো তাঁর কাছে দাসীখত--তা হলেও একটু সুখের আশায় মনসা তাও মেনে নিয়েছিলেন। স্বামীপুত্রসুখের স্বপ্ন সব মেয়েরই থাকে, তাঁরও নিশ্চয়ই ছিল। তাই নত হয়েও তিনি সুকুমারী ও সংসারী হতে চাইলেন, সুখী হতে চাইলেন। পুত্র আস্তিকের জন্ম হল। আর তারপরই নিয়তির ছলনায় শর্ত ভঙ্গ হল। তাতে মনসার কোন দোষ ছিল না। জরৎকারু পুজোর সময় হলে তাঁকে ঘুম থেকে তুলে দিতে বলেছিলেন। নিয়তির মায়ায় সময় বুঝতে না পেরে অসময়ে তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে ফেললেন মনসা। এই তুচ্ছ ও নেহাতই ছেলেমানুষি কারণে শর্ত ভঙ্গ হল এবং তাতে অসন্তুষ্ট হয়ে জরৎকারু পুত্র আস্তিককে নিয়ে সংসার ও মনসাকে ত্যাগ করে সারাজীবনের জন্য চলে গেলেন। সংসার তো ভাঙলই, যে সন্তানকে জন্ম দিলেন, তাকে মানুষ করার সুযোগটুকুও পেলেন না মনসা। তাঁর পূর্ণ-মাতৃত্বের সাধ অপুর্ণই থেকে গেল। অপমানে অসম্পূর্ণ-নারীত্বের জ্বালা বুকে নিয়ে মনসা আবার একা হয়ে গেলেন!
পরিত্যক্ত ও লাঞ্ছিত জীবনটা যখন আর মনসা বইতে পারলেন না, তখন নেতার পরামর্শে ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেন। বুঝলেন, মাথা উঁচু করে বাঁচতে গেলে প্রতিষ্ঠা চাই--দেবীত্ব চাই। শুরু হল আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। প্রথমে, নাগরাজের সাহচর্যে হলেন সাপেদের অধিশ্বরী। তারপর সচেষ্ট হলেন শৈব চাঁদ সদাগরের হাতে পুজো পেয়ে দেবীত্বে উন্নীত হতে, পুজোর প্রসার ঘটাতে। সমাজ চিরকালই ধনীর আচার অনুসরণ করে। চাঁদের মতো ধনকুবের পুজো করলে তাঁর দেখাদেখি অন্যরাও করবে--এটাই নিয়ম। কিন্তু, শৈব চাঁদ কিছুতেই মনসার পুজো করবেন না বলে পণ করলেন। সেই আক্রোশে মনসা তাঁর পুত্রদের হত্যা, বাণিজ্যের প্রভূত ক্ষতি--প্রভৃতি যত রকমের ক্রুর উপায় অবলম্বন করা যায়, সেসব করেও টলাতে পারলেন না চাঁদকে। উপরন্তু, মনসা বার বার অপমানিত হলেন, হেঁতালের বাড়ি খেলেন চাঁদের কাছে। শেষমেশ পুত্রবধূর অনুরোধে অবশ্য চাঁদ নিমরাজি হয়ে মনসার দিকে ফুল ছুঁড়ে দিলেন, তাও আবার বাঁ-হাতে। যে হাতে তিনি আরাধ্য শিবের পুজো করেন, সে হাতে মনসার পুজো করলেন না। আর তাতেই অবশ্য মনসাকে তুষ্ট থাকতে হল।
বাংলা সাহিত্যে ঠাকুরদেবতাদের পুজো প্রচারের যেসব গল্প রয়েছে তাতে এত অপমান, এত বঞ্চনা আর কোন দেবতা বা দেবীকে সহ্য করতে হয়নি। আর কোন দেবদেবীকে মানুষের কাছে এত অপদস্থ হতে হয়নি। মনসার মতো কণ্টকিত জীবন আর কারও নয়। আর এই কণ্টকিত জীবনের কাঁটাই বোধ হয়, মনসার প্রতীক হয়ে উঠল একদিন। মূর্তি ছাড়াও ঘট ও কণ্টকময় সিজুয়া গাছে তাই বোধহয় মনসার পুজো শুরু হল। ফণি ও পাতি কাঁটার নামেও যুক্ত হল, 'মনসা'।