১৯৬৭, টালমাটাল পরিস্থিতি, বিশ্বযুদ্ধঘটিত পৃথিবী, হিরোশিমা নাগাসাকি, ইতিহাসের গায়ে লেপ্টানো হয়েছে নিদর্শনমূলক কিছু মৃত্যুনামাবলী, ঘেঁটে যেতে শুরু করেছে মানুষ-সমাজ-চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধ। সেইসময়েরই কথা; ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরি কাউন্টি ফেয়ার গ্রাউন্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ছেলেমেয়েদের ভিড়, বেশিরভাগেরই হাতে-গলায়-মাথায় ফুলের গোছা, হিপি ছেলেমেয়ারাই বেশি, তাছাড়াও উপস্থিত হয়েছেন সহস্র আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। বিরাট মাঠের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁরা, মুখে হাসি, আলুথালু ব্যাপার, কেউ সদ্য ঘুম থেকে উঠছেন, কেউ পসরা সাজিয়েছেন কারুকর্মের। ছড়ানো ছেটানো ভিড় হঠাৎই একমুখী হতে শুরু করে, কারণ সবার কানেই ততক্ষণে পৌঁছাতে শুরু করেছে অনুষ্ঠান শুরুর রিনরিনে সুরের ঝংকার, যে সুর প্রাচ্য থেকে বহু যত্নে এসে পৌঁছেছে পাশ্চাত্যে, যে সুর আগে কখনও এভাবে শোনেনি তারা, সম্মোহনী সে সুর। ভিড় আরও আরও আবিষ্ট হতে শুরু করেছে, একদিকে ঘন হয়ে এসেছে। সকলেরই মন-মাথা দুলছে। কারও চোখে শ্রুতিমধুর আচ্ছন্নতা, কারও বিস্ময়, কেউ কেউ একাগ্র, ঝাঁকিয়ে চলেছেন মাথা যেন কান বেয়ে-মন বেয়ে-স্নায়ু বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আধ্যাত্মিক নেশাদ্রব্য। সেই আচ্ছন্নতা, বিস্ময় আর ঝাঁকুনিতে সামিল হয়েছেন জিমি হেন্ড্রিক্স, জর্জ হ্যারিসন, জানিস জপলিন; তাঁদেরকে দেখে সহজেই টের পাওয়া যাচ্ছে অবর্নণীয় বিভোরতা। বিহ্বল হয়ে তাঁরা এবং অন্য সকলে তাকিয়ে রয়েছেন সেদিকে, যেদিক থেকে ভেসে আসছিল সুরের ঝর্ণাধারা। সকলে তাকিয়ে ছিলেন মন্টেরী কাউন্টি ফেয়ার গ্রাউন্ডে নির্মিত ওপেন স্টেজের দিকে, যেখানে বেহেড হয়ে নিজেদের বাদ্যযন্ত্রকে সুর-নেশাতুর করে তুলেছিলেন দুই অন্ধ-নক্ষত্র, সুরের ছটায় বিলকুল অন্ধ হয়ে গিয়েছেন তাঁরা, কিছুই দেখতে পাচ্ছেননা, তবু চারিদিক আলো করে রেখেছেন তাঁরাই। আলো করে রেখেছেন অন্ধ-নক্ষত্র রবীন্দ্রশঙ্কর চৌধুরী ওরফে রবিশঙ্কর এবং তাঁর সঙ্গে তবলা সঙ্গতে রয়েছেন আর এক অন্ধ-নক্ষত্র ওস্তাদ আল্লারাখা। সেদিন 'মন্টেরি ইন্টারন্যাশনাল পপ মিউজিক ফেস্টিভ্যাল'-এর মুক্তমঞ্চে সেতারসঙ্গমে পৃথিবীর যাবতীয় হিংস্রতা, অরাজকতা, অবসাদের ভীত কাঁপিয়ে দিতে পেরেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
প্রায় দু' লক্ষ মানুষ সেদিন সাক্ষী থেকেছিলেন সঙ্গীতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম জনপ্রিয় এই উৎসবের। ফেস্টিভ্যালে যাঁরা সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র রবিশঙ্কর ছাড়া আর কোনও শিল্পী সম্মানী নেননি। রবি শঙ্কর নিয়েছিলেন তিন হাজার ডলার। সম্মানীর পুরো টাকাটাই তিনি দিয়ে দিয়েছিলেন সমাজকল্যাণমূলক তহবিলে। উচ্চাঙ্গ সেতারশিল্পী হিসেবে তিনি সব সময়ই ঐতিহ্যমুখী ও শুদ্ধতাবাদী। কিন্তু সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে তিনি সব সময়ই নিজের সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। ১৯৬৬ সালে বিটলসের জর্জ হ্যারিসনের সাথে যোগাযোগের আগে থেকেই তিনি সংগীতের বিভিন্ন ধারা ও তার প্রভাব নিয়ে কাজ করেন। এ সময় তিনি জ্যাজ সংগীত, পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সংগীত ও লোকসংগীত নিয়ে কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন বিশ্বখ্যাত বিটলস ব্যান্ডের সঙ্গে থেকে সুর নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৬৫ সালে বিটলসের জর্জ হ্যারিসন সেতারের সুর নিয়ে গবেষণা শুরু করলে রবিশঙ্করের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয় এবং পরবর্তী সময়ে কাজের সম্পর্ক বন্ধুত্বে গড়ায়। এই বন্ধুত্ব রবিশঙ্করকে খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিমণ্ডলে নিজস্ব অবস্থান সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি পপ সঙ্গীতের গুরু জর্জ হ্যারিসনের 'মেন্টর' হিসেবে পাশ্চাত্য সংগীতজগতে সমাদৃত হন। ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে করা বেশ কয়েকটি কনসার্ট তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠেছিল। ১৯৬৯ সালে 'উডস্টক ফেস্টিভ্যাল'ও মাতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নিখাদ ওয়েস্টার্ন ঘরানার সঙ্গে একমাত্র তিনিই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানা মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
তাঁর বাদ্য-সুর' কে তিনি অবিস্মরণীয় জায়গা করে দিয়েছিলেন বিশ্ব চলচ্চিত্রেও। সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে কানাডার অসামান্য অ্যানিমেশন ছবির স্রষ্টা নরমান ম্যাকলারেন, চেতন আনন্দ, তপন সিংহ, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, র্যালফ নেলসন, কনরাড রুকস, গুলজার -একের পর এক কিংবদন্তী চলচ্চিত্র শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। 'পথের পাঁচালী' নিয়ে তিনি বলেছেন, "সত্যজিতের প্রথম ছবিতে অন্তরের যে নির্মল আবেগ, নিষ্পাপ সরল অনুভূতি খেলা করে সেটা যেন আমাকেও উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। বিভূতিবাবুর বইটিকে-তার গল্প, চরিত্র, পরিবেশ সব-যেন জলজ্যান্ত দেখছিলাম চোখের সামনে। আমার ভেতর থেকেও যেন তারই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া, রেসপন্স হিসেবে সুরগুলো সব ঠেলে বেরিয়ে এল।"
তাঁর গুরুপিতা বাবা আলাউদ্দিন খান ছাড়াও আর এক মহান সুরস্রষ্টা মোৎজার্ট-কে তিনি ভগবান মানতেন। তাঁর কথায়, "মোৎজার্ট নিয়ে তো অঢেল কথা লেখা হয়েছে ওঁর মৃত্যুর পর থেকে। এরকম একটা সাঙ্গীতিক প্রতিভা তিন-চার শতাব্দীতে একবার জন্মায়। আমি তো ওঁকে শঙ্করাচার্য, যীশুখ্রীষ্ট, বিবেকানন্দ বা রামানুজ গোত্রের মানুষ বলে ভাবি... মোৎজার্টের একটা বড় ব্যাপার যে, তিনি ও তাঁর সঙ্গীত খুব সরল, আবার জটিলও। এ যে কী কঠিন ব্যাপার তা আমরা যাঁরা গানবাজনা করি তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। একেই তো বলে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত। মানব-সভ্যতা যতদিন থাকবে ততদিনই ভদ্রলোককে শুনতে হবে। আর যেই শুনবে সে-ই জানবে সঙ্গীতে ভগবানের রূপ কী রকম।"
একজন প্রকৃত স্রষ্টার মতোই স্বীকৃতি নিয়ে কোনও ভাবনা ছিলো না তাঁর, স্নায়ুতাড়না ভাবাতো তাঁকে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "১৯৬৬ সালে আমি যখন জর্জ হ্যারিসনের সাথে কাজ শুরু করি, আমি একজন পপ স্টারের মতো হয়ে উঠেছিলাম। যেখানেই যাচ্ছিলাম, স্বীকৃতি পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেটা আমি একদমই পছন্দ করিনি।“' তবু স্বীকৃতি তাঁর পিছু ছাড়েনি|
অবিশ্রান্ত ধারায় আমৃত্যু নিজের যা কিছু, সবই নিঃস্ব করে দিয়ে গিয়েছেন পৃথিবীর মানবসভ্যতায়। পরিশেষে, তাঁর ভগবান- মোৎজার্টের উদ্দেশ্যে তাঁর বলা কথাই তাঁকে ফিরিয়ে দেব-
রবিশঙ্কর'কে নিয়ে তো অঢেল কথা লেখা হয়েছে ওঁর মৃত্যুর পর থেকে। এরকম একটা সাঙ্গীতিক প্রতিভা তিন-চার শতাব্দীতে একবার জন্মায়। আমি তো ওঁকে শঙ্করাচার্য, যীশুখ্রীষ্ট, বিবেকানন্দ, রামানুজ বা মোৎজার্ট গোত্রের মানুষ বলে ভাবি... রবি শঙ্করের একটা বড় ব্যাপার যে, তিনি ও তাঁর সঙ্গীত খুব সরল, আবার জটিলও। এ যে কী কঠিন ব্যাপার তা যাঁরা গানবাজনা করেন তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পান। একেই তো বলে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত। মানব-সভ্যতা যতদিন থাকবে ততদিনই ভদ্রলোককে শুনতে হবে। আর যেই শুনবে সে-ই জানবে সঙ্গীতে ভগবানের রূপ কী রকম।