আজ যে, দক্ষিনেশ্বরে বিশেষ উৎসব ছাড়া সারা বছর যেভাবে মানুষের ভিড় লেগে থাকে বা বলা চলে যে বিপুল মানুষের সমাগম ঘটে, তার প্রতিষ্ঠা নেহাৎ কম কষ্টসাধ্য ছিল না। কিন্তু যাঁর টানে আপামর ভক্তকুল দীর্ঘ প্রতীক্ষা সত্ত্বেও এতটুকু বিরক্ত হন না বা ক্লান্তি উপেক্ষা করেন তিনি মা ভবতারিণী, সেই নামেই তিনি পরিচিত। কিন্তু তাঁর যে আরো দুই বোন আছেন এবং তারাও যে প্রতিষ্ঠিত এমনটা হয়তো অনেকেরই অজানা। কিন্তু মনে হতেই পারে পাথরের মূর্তির আবার বোন? আজ সেই গল্পই বলবো।
এই ভবতারিণী মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী নবীন ভাস্কর। তাঁর জন্ম ১৮০৬ সালে বর্ধমান জেলার দাঁইহাটায়। বর্তমানে দাঁইহাটা পৌরসভা পূর্ব বর্ধমানের অন্তর্গত। ১৮৫০ সালে নবীন ভাস্করের বাবা শ্রী রামচন্দ্র ভাস্কর কলকাতায় ৩৭৪ আপার চিৎপুর রোডে 'ওরিয়েন্টাল স্টোন ওয়ার্ক' নামে একটি পাথরের মূর্তি নির্মাণের স্টুডিও করেছিলেন। বর্তমানে এই ঠিকানার কোনো অস্তিত্ব নেই। যদিও রানী রাসমণি তাঁর স্বপ্নের কালী মূর্তি নির্মাণে প্রথম দাঁইহাটায় ভাস্করের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আসেন। কিন্তু রানীকে প্রত্যাখ্যানের পর ভাস্করের নির্মিত একটি ঠাকুর অপ্রত্যাশিতভাবে তারই হাতে ভেঙে যাওয়ায় তিনি রানীর কাছে যান ক্ষমা চাইতে। তাতে রানী খুশি হয়ে স্বপ্নের রূপ ও ঠাকুরের আকার বলে দেন। শুরু হলো নির্মাণ। কিন্তু কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন ভাস্কর।
দক্ষিনেশ্বরের কালীমূর্তি নির্মাণের ২ বছর আগে নবীন ভাস্কর আরো দুইটি মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু প্রথম মূর্তির আকার মন্দিরের গর্ভগৃহের তুলনায় ছোট হয়ে যাওয়ায় তার সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই ভাস্কর খানিক বিমর্ষ হয়ে পড়েন এবং সেই প্রথম তার নির্মিত মূর্তির প্রতিষ্ঠা প্রত্যাখ্যাত হয়। এর পরের মূর্তিটির ক্ষেত্রেও বিষয়টি খানিক একই রকম হয়, তবে এবার আকার এতটাই বড় হয়ে যায় যে তা গর্ভগৃহে প্রবেশ করানো যায় নি। আবারো এলো প্রত্যাখ্যান। এরপর নির্মিত মূর্তিটি দক্ষিনেশ্বরে প্রতিষ্ঠিত ভবতারিণী। এতো গেলো তিন বোনের নির্মাণের কথা। বোন বলার কারণ হলো, মূর্তি তিনটি একই কষ্টি পাথর থেকে নির্মিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে তখন কষ্টি পাথর খুব সুলভ ছিলনা। কিন্তু নবীন ভাস্করকে এব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ সাহায্য করেন বর্ধমানের মহারাজ। তিনি পশ্চিম জামালপুরের একটি পাহাড় কিনে নেন, সেই পাথর দিয়েই এই তিন মূর্তি হয়।
কিন্তু নির্মিত মূর্তি তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। তাই প্রথম কালী মূর্তির অর্থাৎ ছোট মূর্তির শ্রী শ্রী ব্রহ্মময়ী কালীমাতা নামে স্থাপনা হলো বরানগর বাজার ২২৫ নম্বর প্রামানিক ঘাট রোডে কালীবাড়িতে ১৮৫৩ সালে রামগোপাল দে ও দুর্গাপ্রসাদ দে’র হাত ধরে । দক্ষিনেশ্বর মন্দিরের দুবছর আগে বরানগরের এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। মায়ের জন্ম দিন মাঘী পূর্ণিমাতে উদযাপিত হয়। কালী পুজোর দিন বিশেষ পুজো হয়, ভোগ হয় তবে অন্ন ভোগ নয়। একই পাথর থেকে নির্মিত হওয়ায় এবং আকারে ছোট হওয়ায় শ্রী রামকৃষ্ণ প্রথম এই মাকে 'মাসি' বলে সম্বোধন করেন, সেখান থেকেই ইনি মেজো মাসি নাম খ্যাত। আজ ও তিনি মহাসমারোহে নিত্য পূজিতা হন। দ্বিতীয় মূর্তি আকারে বেশ বড় হওয়ায় তার স্থাপনা হয় গোয়াবাগান রোড়ে শ্রী শিবচরণ গোহ’র প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে। এই মন্দির বৃন্দাবন বোস লেন, ষ্টার থিয়েটারের কাছে। তিনি নিস্তারিণী কালী নামেই পূজিতা। আর ছোট হলেন দক্ষিনেশ্বরের মা ভবতারিণী। এই হলেন ভবতারিনীর দুই বোন।
নবীন ভাস্করের পূর্ব পুরুষরা ও তার পরবর্তী ২ প্রজন্মের অনেকেই পাথর খোদাই কাজে দক্ষ ছিলেন। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম নাতি নিমাই ভাস্কর, প্রপৌত্র প্রণব ভাস্কর কেউ এই শিল্পকে বাঁচাতে পারেন নি। ফলে সব বিলুপ্ত। তবে তার সৃষ্ট এই তিন বোন আজও ভক্ত কুলের আবেগ, বিশ্বাস ও আকর্ষণের কেন্দ্র।