শিশির ও 'সীতা'-র উপাখ্যান

বাংলা নাট্যমঞ্চের সূর্য গিরিশচন্দ্র ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে যখন অস্তমিত হলেন, তখন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর বয়স বাইশ বছর। এর এক বছর পর ১৯১৩-তে তিনি এমএ পাশ করে সেকালের মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমানে, বিদ্যাসাগর কলেজ) ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন। অধ্যাপক হিসেবে তাঁর খুব নাম হল, সৌখিন নাট্যাভিনেতা হিসেবেও তাঁর বেশ নামডাক তখন। 

নাটকের প্রতি তাঁর দুর্বলতা সেই ছাত্রজীবন থেকেই। যে কবিতা ও নাটক অন্যান্য ছাত্ররা এড়িয়ে চলত, সেই কবিতা ও নাটক পাঠ করতেই তাঁর ভীষণ ভালো লাগত। স্কটিশ চার্চ কলেজে বিএ পড়ার সময় তাঁর প্রথম নাট্যাভিনয়। অভিনয় করলেন শেক্সপিয়ারের 'জুলিয়াস সিজার'- নাটকে ব্রুটাস চরিত্রে। কল্পনার চরিত্র বাস্তবে রূপায়িত করতে পেরে বেশ তৃপ্ত হলেন শিশিরকুমার। তারপর শুধু অভিনয়েই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন না, পরিচালনার কাজেও অবিলম্বে তাঁর হাতেখড়ি হল, 'কুরুক্ষেত্র'-নাটকে। নাটকটি কবি নবীনচন্দ্র সেন-এর 'কুরুক্ষেত্র' কাব্যের নাট্যরূপ। 

সৌখিন নাট্যমঞ্চে যখন শিশিরকুমার দাপিয়ে অভিনয় করছেন, তখন একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা তাঁর জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিল। মাত্র দু'বছরের শিশুসন্তানকে রেখে তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করে বসলেন। শিশিরকুমার এই ঘটনায় যখন একেবারেই ভেঙে পড়লেন; তখন বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ী ও গুরুস্থানীয়রা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন, অভিনয়কেই আঁকড়ে ধরে ঘুরে দাঁড়াতে উৎসাহ দিলেন। স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে আগেই বলেছিলেন, "You are wasting yourself, Sisir, your true vocation is on stage." কথাটা শিশিরকুমারকে নতুন করে প্রাণিত করল। তিনি ঠিক করলেন সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে পেশাদার অভিনেতা হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করবেন। সেই আত্মপ্রকাশের উদ্দীপনা তাঁর মধ্যে এমন প্রবল হল যে, স্যার আশুতোষের দেওয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক করে নেওয়ার অঙ্গীকারও তাঁর কাছে তুচ্ছ বলে মনে হল।

চাওয়া ও পাওয়ার মেলবন্ধন শিশিরকুমারের জীবনে ঘটল অচিরেই। ম্যাডান থিয়েটার বাংলা রঙ্গমঞ্চে তখন পেশাদার থিয়েটারের প্রযোজক হিসেবে ব্যবসা করতে এসে ক্রমাগত লোকসান করে চলেছেন। তাঁরা একজন শিক্ষিত নট খুঁজছিলেন, যিনি নিজের কাঁধে একটা নাটক টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। শিশিরকুমারের সৌখিন মঞ্চের অভিনয় সম্পর্কে তাঁরা যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। ফলে, তাঁরা যখন খবর পেলেন যে, শিশিরকুমার পেশাদার শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশে ইচ্ছুক, তখন তাঁরা যাকে বলে একেবারে হামলে পড়লেন। ফলে, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে শিশিরকুমার আত্মপ্রকাশ করলেন। 'আলমগীর'-নাটকে, নামচরিত্রে। নাটকটিতে ম্যাডান কোম্পানির কপাল ফিরলেও, অভিনেতা হিসেবে শিশিরকুমার স্বস্তি পেলেন না। পেশাদার মঞ্চের অভিনেতা হয়ে তিনি পেশাদারিত্বের শেকলে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, এই বন্ধন তাঁর কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না। ফলে, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বাঁধন ছিঁড়ে ম্যাডানদের সংশ্রব ত্যাগ করলেন।

না, আর কোন অধীনতা নয়। কোন পেশাদার নাট্যসংস্থায় যোগ দিলেন না শিশিরকুমার। পুরাতন কিছু গুণীশিল্পী এবং বেশ কিছু নতুন ছেলেমেয়েকে তালিম দিয়ে তৈরি করে ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে লাগলেন নিজস্ব নাটকের দল। চিন্তা করতে লাগলেন নতুন প্রজন্মের দর্শকের জন্য নতুন আঙ্গিকে ও অভিনয়ের নব্যধারায় নাটক পরিবেশনার কথা। সুযোগ এলো, ১৯২৩ সালে। ইডেন গার্ডেন-এর  ক্যালকাটা এগজিবিশনে দলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মঞ্চস্থ করলেন ডি এল রায়ের 'সীতা' নাটকটি। যে নাটকটি ততটা জনপ্রিয় ছিল না, যে নাটকটির অভিনয়সম্ভাবনার চেয়ে সাহিত্যগুণ বেশি; সেই নাটকটি সফলভাবে মঞ্চস্থ করে শিশিরকুমার সকলকে তাক লাগিয়ে দিলেন। বিপুল প্রশংসা পেয়ে মনে মনে ঠিক করলেন, এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেই নিজস্ব দল ও স্বাধীন শিল্পী হিসেবে শিশিরকুমার--উভয়েই আত্মপ্রকাশ করবেন। অবশেষে বছর ঘুরে ভাবনাকে কাজে রূপান্তরিত করার সময়ও এলো একদিন।

১৯২৪ সাল। মনমোহন থিয়েটার ইজারা নিয়ে শিশিরকুমার তার নাম দিলেন, 'নাট্যমন্দির'। ডি এল রায়ের 'সীতা' নাটকের মহলা হল কয়েক মাস ধরে। কাগজে কাগজে অভিনয়ের দিনও বিজ্ঞাপিত হয়ে গেল। বিজ্ঞাপনে বড় বড় করে লেখা হল, শিশিরকুমারের নতুন করে আত্মপ্রকাশের কথাও। প্রচার ও প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই  সত্ত্ব কিনতে গিয়ে খবর এলো দ্বিজেন্দ্রপুত্র দিলীপকুমার রায়ের কাছ থেকে মাত্র ক'দিন আগেই 'সীতা'-র সত্ত্ব কিনে নিয়েছে বিপক্ষ নাট্যগোষ্ঠী আর্ট থিয়েটার। আরও জানা গেল, শিশিরকুমারের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে, তাঁকে হেঁয় করতে আর্ট থিয়েটার এই ঘটনাটা পরিকল্পনা করেই ঘটিয়েছে! ব্যস, মাথায় হাত পড়ল সব্বার, বিজ্ঞাপনে ঘটা করে শিশিরকুমারের আত্মপ্রকাশের যে কথা বলা হয়েছে, সে কি সম্ভব হবে না? তাহলে কি লোক হাসাহাসিই ভবিতব্য! না, শিশিরকুমারের নেতৃত্বে তেমনটা কি আর অত সহজে হবার! তাঁর শিল্পী ও সাহিত্যিক বন্ধুদের সহযোগিতায় রাতারাতি লেখা হল, গীতিমুখর পালা, 'বসন্তলীলা'। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে এই পালার অভিনয়ের মাধ্যমেই নাট্যমন্দিরের উদ্বোধন হল, এবং একটি ছোট্ট চরিত্রে শিশিরকুমারের আত্মপ্রকাশও ঘটল। দর্শকের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে নাট্যমন্দির, নতুন উদ্যম ও শিশিরকুমার একইসঙ্গে অভিনন্দিত হলেন।

শিশিরকুমারের এক গোঁ 'সীতা' মঞ্চস্থ করবেনই। সীতার বিষয় পৌরাণিক, বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রলালের কোন সত্ত্ব নেই। সুতরাং, বিষয়টি নিয়ে নাটক লিখতে তো কোন বাধা নেই। বন্ধু যোগেশ চৌধুরী যদিও কোন নাটক এখনো পর্যন্ত লেখেননি, তবু তাঁর সংলাপের হাত ভালো। ফলে, শিশিরকুমার যোগেশকে দিয়েই নাটক লেখাবেন স্থির করেই ফেললেন। নাটকের আঙ্গিক ও পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে তাঁকে দিয়ে 'সীতা' লিখিয়েও ফেললেন। নাটকের ঐতিহাসিক খুঁটিনাটি ও তথ্য যাতে নির্ভুল থাকে সেজন্য তিনি স্বয়ং শরনাপন্ন হলেন ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভাষাতাত্ত্বিক ও সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। গান লেখালেন, কবি হেমেন্দ্রলাল রায়কে দিয়ে। সংগীত পরিচালনার ভার দিলেন, কৃষ্ণচন্দ্র দে ও গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়কে। দৃশ্যপট ও সাজসজ্জায় রইলেন, শিল্পী চারু রায়। প্রযোজনাটি সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে সমস্ত মেধা ও প্রতিভার একত্র সম্মিলন ঘটিয়ে অসাধ্যসাধন করেছিলেন শিশিরকুমার। হলও তাই।

নাট্য ও সিনেমা সমালোচক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন, "সীতা' নাটকটি সব দিক থেকে নতুনত্বের দাবী নিয়ে দর্শক সমাজে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। বিলিতি ভাবধারা বর্জন করে--কনসার্টের পরিবর্তে রোশন চৌকি, দর্শক-আসনে বাঙ্গলা অক্ষরের ব্যবহার, প্রবেশপথে আলপনা, পূর্ণ কলস আর ধূপ ও অগরু চন্দনের গন্ধ দর্শকদের বিমোহিত করেছিল। আলোক প্রক্ষেপনের চাতুর্য, সীনের পরিবর্তে বক্স সেটের ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণ নতুন।" হ্যাঁ, এই নাটকেই আলোক প্রক্ষেপনে শিশিরকুমার ফুটলাইটের কৃত্রিম আবহের পরিবর্তে উপর ও আশপাশ থেকে স্বাভাবিকভাবে আলো ফেলার আধুনিক রীতিটির প্রবর্তন করলেন বাংলা মঞ্চে। এর সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন স্বাভাবিক অভিনয়ের প্রাণপ্রাচুর্য। জনতার দৃশ্যে একশো জন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দিয়ে অভিনয় করালেন--যেটা এর আগে বাংলা রঙ্গমঞ্চে দেখাই যায়নি।  সবমিলিয়ে দর্শক অনেক নতুনপ্রাপ্তির সমারোহে সমৃদ্ধ হলেন, আপ্লুত হলেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে রসরাজ অমৃতলাল বসু ঘোষণা করলেন, "শিশিরকুমারই থিয়েটারে নবযুগের প্রবর্তক।" 

সবচেয়ে বড় কথা এই নাটকের প্রথম রজনীতে দর্শক হয়ে এসেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, "শিশির ভাদুড়ীর প্রয়োগ-নৈপুণ্যে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে।" রসরাজ ও কবিগুরু যুগপৎ দুই মহারথীর প্রশংসা এবং দর্শকের ভালোবাসা শিশিরকুমারকে কিংবদন্তি করে তুলল। তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হল না প্রায় আধ দশক। যে 'সীতা'র হাত ধরে তিনি জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁলেন, নতুন পথ নির্মাণ করলেন; সেই 'সীতা' কোনদিনই তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গেল না, হয়ে রইল আজীবনের উত্থান-পতনের সাক্ষী। সেও আর এক অন্য ইতিহাস...


তথ্যঋণ : 'বাংলা রঙ্গালয় ও শিশিরকুমার' - হেমেন্দ্রলাল রায়; 'সোনার দাগ' - গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...