সিরাজের কলকাতা আক্রমণ

সুবে বাংলা তখন দেশের প্রাণকেন্দ্র। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাই সম্পদের কেন্দ্র। কলকাতা তখনও জ্বলে ওঠেনি। মধ্যগগনে দিল্লি। ঢাকা থেকে মাকসুদাবাদে এলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। নাম হল মুর্শিদাবাদ। সাহেবদের নজর পড়ল মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদকুলির পরে সুজাউদ্দৌলা এবং সরফরাজ নবাব হলেন। সরফরাজকে হারিয়ে সিংহাসনে বসলেন আলীবর্দী খাঁ। আর তাঁর দৌহিত্র হলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাউদ্দৌলা। 
 
ভারত তথা বাংলার ইতিহাসের বিতর্কিত চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম সিরাজ, কিন্তু মাতৃভূমির প্রতি তাঁর ভক্তির কোন তুলনা নেই। মাতৃভূমির জন্য তাঁর সংগ্রামও ইতিহাসে নজির হয়ে রয়েছে। বাংলা তো বটেই, ভারতবর্ষের সমস্ত রাজ্যের স্বাধীনতার সূর্য তাঁর ব্যর্থতার চিহ্ন মাথায় নিয়েই অস্ত গিয়েছিল পলাশী তীরে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন যে নাটকের যবনিকা পড়েছিল, ভুলন্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা। সূত্রপাত ঘটেছিল বছর খানেক আগেই। বলা ভাল, সিরাজের সিংহাসন আরোহণের সময়, ১৫ এপ্রিল ১৭৫৬।
 
ইংরেজদের সঙ্গে বাংলার নবাবের সংঘাত কিন্তু বেশ পুরনো। অবশ্য আলিবর্দী কিন্তু প্রত্যেকের সঙ্গেই সদভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু দিনে দিনে ব্রিটিশ বণিকদের আধিপত্য বেড়েই চলছিল। কলকাতার বুকে সাহেবদের দূর্গের বহরও বেড়ে চলেছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের কেবল অনুমতি ছিল শুধু ব্যবসা বাণিজ্য করার। তার জন্য দূর্গের কী প্রয়োজন, আলিবর্দীও এই প্রশ্নের উত্তর পাননি। ফলে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তখনই। আদপে তারা শাসক হতে চাইছিল। 
 
সিরাজ সিংহাসনে বসা মাত্রই মুখোমুখি প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে দুই শিবির। একদিকে সিরাজ উঠেপড়ে লাগলেন ব্রিটিশদের জব্দ করতে। অন্যদিকে ব্রিটিশ গভর্নর ড্রেকের সঙ্গে দেশীয় রাজাদের আঁতাত আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বাংলার শাসক হিসাবে সিরাজকে মেনে নিতে পারেননি কেউই। এমনকি তাঁর বড়মসি ঘসেটি বেগমও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। সেকথাও জানতে পেরেছিলেন সিরাজ। তাঁকে তাই মতিঝিল প্রাসাদ থেকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের হীরাঝিল প্রাসাদে নজরবন্দি রাখার উদ্দেশ্যে। মীরজাফর, জগৎ শেঠ সকলেই একে একে যোগ দিলেন ষড়যন্ত্র। কিন্তু ষড়যন্ত্র দমনের তেমন উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সিরাজ নিলেন না। এর কারণ অবশ্য জানা যায়নি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশ শক্তিকে সমূলে উৎখাত করতে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন তরুণ নবাব। সঙ্গে বিশাল সেনাবাহিনী।
 
শুরুতেই আক্রমণ করলেন না সিরাজ। তৎকালীন ভারতের সমূচিত আদব কায়দা তো শিখিয়ে দিতে হবে ব্রিটিশদের। তাই আক্রমণের আগে নারায়ণ দাস নামের এক দূতকে পাঠালেন ড্রেকের কাছে। শর্ত ছিল দুটো। প্রথমত, দুর্গ সংস্কার বন্ধ করতে হবে। আর দ্বিতীয়ত, দেওয়ান রাজবল্লভের পলাতক পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে নবাবের হাতে সমর্পণ করতে হবে। কিন্তু এই দুই শর্ত শোনা মাত্রই গর্জে উঠলেন ড্রেক, অসম্ভব। অতএব যুদ্ধ ছাড়া কোনো রাস্তাই খোলা থাকলো নানবাবের সসৈন্যে আসার খবর পেয়েই বাগবাজারের পেরিন্স পয়েন্টে তৈরি ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। তাদের সঙ্গে ছিল পর্তুগিজ এবং হিন্দু ফৌজ। কিন্তু সিরাজের বাহিনী এসবের জন্য তৈরি হয়েই এসেছে। দিনটা ১৫ জুন, ১৭৫৬। সিরাজের বাহিনীর এসে দাঁড়ালো কলকাতার উপকণ্ঠে। সুশিক্ষিত নবাবি সেনাবাহিনীর কাছে ব্রিটিশ বাহিনী আদৌ দাঁড়াতেই পারছিল না। তবুও তিনদিন ধরে চলল যুদ্ধ। পার্কস্ট্রিট, রানী মুদির গলিতে কামান বসিয়ে গুলি গোলা চলল। ফোর্ট উইলিয়াম গুঁড়িয়ে দিল সিরাজ বাহিনী। শেষ পর্যন্ত ১৮ জুন লালদীঘির যুদ্ধে পরাজিত হল ব্রিটিশ বাহিনী। 
 
পরদিন ভোর হতে না হতেই হুগলি নদীর ঘাট থেকে ছেড়ে গেল কয়েকটি নৌকা। সামান্য কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া ব্রিটিশদের সকলেই কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন। কলকাতা শহর দখল করলেন নবাব। দাদুর নামে কলকাতার নাম রাখলেন, আলিনগর। প্রিয় দাদুর প্রতি এই ছিল নাতির শ্রদ্ধার্ঘ। ২০ জুন পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে বসল এক বিরাট সভা। সেখানে উপস্থিত কলকাতার অভিজাত ব্যক্তি উমিচাঁদ এবং পলাতক কৃষ্ণবল্লভ। দুজনেই মেনে নিলেন সিরাজের আধিপত্য। আর সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গ পরিচালনার ভার দিয়ে সিরাজ ফিরে এলেন রাজধানী মুর্শিদাবাদে। 
 
বাংলার জয় হয়েছিল ঠিকই কিন্তু জমতে শুরু করেছিল সিঁদুরে মেঘ। যে মেঘ পলাশীর প্রান্তরে বৃষ্টি হয়ে ঝরেছিল ১৭৫৭-এর ২৩ জুন। আঁধারে ঢেকে গিয়েছিল বাংলার আকাশ। তারপর দুই শতকের গ্লানি।
 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...