শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা সারাবছর মাথা যন্ত্রণা! কড়া রোদ বা ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় পড়লেই মাথা ব্যথা শুরু| অনেক ক্ষেত্রে একে মাইগ্রেন ভাবা হলেও সাইনাসের কারনেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে| অনেককেই বলতে শোনা যায় মাথা যন্ত্রণার কারণ আসলে সাইনাস| সেই সাইনাস নিয়েই আজ আমরা আলোচনা করব|
সাইনাস আসলে কি?
সাইনাস হলো করোটির মধ্যে থাকা ফাঁকা জায়গাগুলির মধ্যে একটি কানেকশন সিস্টেম| করোটির মধ্যে থাকা গহ্বরগুলির মধ্যে একটি আছে যা মোটামুটি ইঞ্চি খানেক লম্বা আর বাকিগুলি আকারে ও আয়তনে ছোট হয়ে থাকে| আমাদের শরীরের যেসব জায়গায় এই সাইনাস অবস্থান করে তা হলো, চোখ ও গালের মধ্যবর্তী স্থানে, এটিই হল শরীরের সবচেয়ে বড় সাইনাস একে বলা হয় ম্যাক্সিলারি সাইনাস| এছাড়াও রয়েছে, কপালের নিচের দিকে ঠিক মাঝখান বরাবর জায়গায় থাকে সাইনাস, একে বলা হয় ফ্রন্টাল সাইনাস| দুই চোখের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে এথময়েড সাইনাস| এগুলি ছাড়াও রয়েছে স্ফেনয়েড সাইনাস| এই সাইনাস নাকের হাড়ের ঠিক পিছনের দিকে অবস্থান করে থাকে| এই হলো সাইনাসের অবস্থানের কথা| এবার আসা যাক সাইনাসের গঠনগত দিকের কথায়| সাইনাসের চারপাশে থাকে পিঙ্ক রঙের সফ্ট টিস্যু যাদের মিউকোসা বলা হয়ে থাকে| সাইনাসের এই গঠন মূলত নাকের ভিতরের অংশকে আর্দ্র করে রাখে এবং বাতাস যা নাকের সাহায্যে আমরা টেনে নিয়ে থাকি তা পরিশুদ্ধ করা| নাকের দুই দিকের প্যাসেজের মধ্যে পাঁচিল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেপ্টাম|
কিন্তু আমাদের সাইনাসের সমস্যা হয় কেন?
সাইনাস কেন হয় তার উত্তর বিশেষজ্ঞরাও দিতে পারেনি। এই সাইনাসের কারণ আজ ডাক্তারদের কাছে অজানা। সাইনাস আসলে আমাদের জন্য কি কাজ করে সেটাও অনেকের কাছে কাছেই অজানা কারণ এই সাইনাসের কাজ নিয়ে রয়েছে দোটানা। একটি থিওরি বলে নাসিকাগহ্বরকে আর্দ্র করতে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে কিন্তু অন্যদিকে আরেকটি থিওরি বলে, আমাদের গলার স্বর বাড়াতে এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
সাইনাস থেকে কি কি সমস্যা হতে পারে?
১) সাইনাস থেকে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে প্রখরতার ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথম আসে যে নামটা সেটা হলো, অ্যাকিউট সাইনুসাইটিস- এ ধরণের সাইনাসের সমস্যা মূলত হয় ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণের ফলে। এই ক্ষেত্রে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসের আক্রমণের ফলে নাসিকাগহ্বর জ্বলতে থাকে। অতিরিক্ত মিউকাস, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, গালে অস্বস্তি, মাথা যন্ত্রনা প্রভৃতি সমস্যা পরিলক্ষিত হয় এই ধরণে সাইনোসাইটিস হলে।
২) ক্রনিক সাইনুসাইটিস- বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকা সাইনাস ইনফেকশন পরে ক্রনিক সাইনুসাইটিসের রূপ নিতে পারে। পরপর একই স্থানে ইনফেকশন ঘটার ফলে নাসিকা গহবরের মধ্যে জ্বলন বেশিদিন স্থায়ী হয়ে থাকে।
৩) ডেভিয়েটেড সেপ্টাম-সেপ্টাম যেহেতু নাকের দুই দিককে একে ওপরের থেকে আলাদা করে থাকে এবং নাসিকা গহবরের থেকে সে যথারীতি দূরে অবস্থান করে তাও কিছু ক্ষেত্রে বাতাসের চলাচলের পথ আটকে যেতে পারে।
৪) হে জ্বর- ফুলের রেনু, পোষ্যের লোমে থাকা ড্যানডার, ধুলোবালি, পোকামাকড়ের স্পর্শে অ্যালার্জি হয়। এই অ্যালার্জির ফলে নাসিকা গ্রন্থির অধিক প্রদাহ বা জ্বলন ছাড়াও, নাক বন্ধের সমস্যা, বারবার হাঁচি হওয়া, গলা খুসখুস করা প্রভৃতি সমস্যা এই জ্বরের সময় দেখা দেয়|
৫) অনুনাসিক পলিপ- অনেক মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় নাসিকার অভ্যন্তরে অতিরিক্ত মাংস পিন্ড গজিয়ে উঠেছে। একেই বলা হয় অনুনাসিক পলিপ। নাসিকা গহ্বরের মধ্যে জন্মানো ছোট ছোট পাউচের মতো বস্তুগুলি আসলে প্রদাহ, অ্যাজমা বা কোনো অ্যালার্জির ফলে তৈরী হয় মাংস পিন্ড। নাকের ভিতরে এই পলিপের অবস্থান কখনো সম্পূর্ণভাবে একটি নাক বন্ধ করেও দিতে পারে।
সাইনাসের ট্রিটমেন্ট কি আছে?
সাইনাসের ট্রিটমেন্ট নানাভাবে করা হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে যেসব পদ্ধতিগুলি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় সেগুলি হলো,
১) অ্যান্টিবায়োটিক- সাইনাসের ইনফেকশনের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা সর্বপ্রথম যে ওষুধের ব্যবহার করেন তা হলো অ্যান্টিবায়োটিক। ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে তা শীঘ্রই উপকার দেয়।
২) অ্যান্টিহিসটামিনস- অ্যাল্যার্জিক রাইনাইটিস থেকে সাইনাসঘটিত যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয় তার চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণত এই জাতীয় ওষুধ ব্যবহৃত হয়।
৪) ডিকনজেস্টেন্টস- এই জাতীয় ওষুধ নাকের মধ্যে থাকা রক্ত জালিকাকে সংকুচিত করতে সাহায্য করে থাকে। এর সাথেই নাসিকার ভিতরে অবস্থিত নাসাল টিস্যুকেও সংকুচিত করে। এর ফলে অতিরিক্ত সাইনাস বা অতিরিক্ত মিউকাস জমতে পারে না।
৫) নাসাল স্প্রে- অতিরিক্ত মিউকাস জমে নাক বন্ধের ক্ষেত্রে এই জাতীয় স্যালাইন স্প্রে নাক খুলতে সাহায্য করে থাকে।
৬) সাইনাস সার্জারি- যখন সব চিকিৎসা পদ্ধতি ফেল হয়ে যায় সেই সময় চিকিৎসকেরা সার্জারির সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। নাকের ভিতরে পলিপ জন্মালে তখনও চিকিৎসকেরা সার্জারির পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
তাহলে আজ সাইনাস নিয়ে জানলাম নানা কথা। সাইনাসের কারণ, তার চিকিৎসা পদ্ধতি সবটাই আজ তুলে ধরলাম। এই রোগটি কমবেশি সকলেরই হয়ে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে এই রোগটি কোনো ক্ষতি না করলেও মাঝে মধ্যে এই রোগটিই মারাত্মক আকার নিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এর থেকে মাইগ্রেনের সমস্যা হয়ে যেতে পারে। পুরোটাই সম্ভব হয় তখন যখন এই সাইনাসের সমস্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে ফেলে রাখা হয়। তাই আপনি যদি মনে করেন আপনার সাইনাসের সমস্যা হচ্ছে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই নিয়ে নেবেন।