আজ রবিবার লৌকিক দেবতাদের নিয়ে কথা বলার দিন। বাংলার লোকায়েত দর্শন, লৌকিক দেবদেবীর ইতিহাস সুপ্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। বাংলার লৌকিক দেবদেবীর ইতিহাসে আমরা সিনি দেবীকে নিয়ে আলোচনা করব, রাঢ় বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় লৌকিক দেবতা হলেন সিনি দেবী।
বাঁকুড়া, হুগলি, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায় আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে, প্রান্তিক গ্রামগুলিতে সিনি পুজোর প্রচলন রয়েছে। আদিবাসীরা দেবী অর্থে সিনি শব্দটি করতেন। আদিবাসীদের উৎসব; তাদের থেকেই রাঢ় বাংলার অন্যতম জনপ্ৰিয় লৌকিক পুজো গ্রামীণ সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে।
সাধারণত তথাকথিত অনুন্নত সম্প্রদায়ের হিন্দুদের মধ্যে এই পুজোর চল রয়েছে। তবে বহু এলাকায় বর্ণ হিন্দুরা এবং রাজপুত সামন্ত নৃপতিরাও সিনি পুজো করে থাকেন। অন্যান্য লৌকিক দেবতাদের তুলনায় পল্লি সমাজের মধ্যে সিনি দেবতা অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। ভক্তদের বিশ্বাস সিনি দেবী শস্যদাত্রী, তিনি গ্রাম রক্ষা করেন। তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই যেকোন রকম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব। শস্য বা কৃষি দেবী রূপে, মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায়, বৃষ্টির আশায়, দুর্ভিক্ষ নিবারণ, হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা, গ্রামের সার্বিক কল্যাণ ইত্যাদি নানা আকাঙ্খায় সিনি দেবী পুজো করা হয়। অধিকাংশ সিনি পুজোর স্থান থান গাছতলা।
রাঢ় বাংলার প্রধান তিনটি জেলা হুগলি, বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুরে সিনি পুজোর অধিক্য দেখা যায়। যদিও হাল আমলে, এই পুজো সমাজে তার আগের মতো প্রভাব হারিয়ে ফেলেছে। সিনি দেবীর সবচেয়ে অধিক্য দেখা যায় বাঁকুড়া জেলায়। বাঁকুড়ার পল্লি অঞ্চলে ছাতনা, পাঁচাল, ওলদা ইত্যাদি স্থানে থানে সিনির পুজো চলে। বাঁকুড়ার পরেই মেদিনীপুর জেলার সিনি পুজোর নাম করতে হয়, কারণ অবিভক্ত মেদিনীপুরে সিনি পুজোর অধিক্য দেখা যেত। আজও ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরে সিনি পুজোর চল রয়েছে। বেলপাহাড়ি ও গড়বেতা অঞ্চলের সিনি পুজো খুবই জনপ্রিয়। হুগলী জেলার গোঘাট থানার কয়াপাটের কয়া সিনির পুজো হয়। হুগলি জেলায় কয়াপাটের এই সিনি পুজো বা কয়াসিনি পুজো বর্ণহিন্দু সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
রাঢ় বাংলার জেলাগুলিতে সিনি অন্তে বহু গ্রামের নাম রয়েছে। যেমন পুরুলিয়ার দুয়ার সিনি। গাছতলাতে, পাহাড়ের কোলে 'সিনি' মায়ের স্থান। সিনি দেবী বনদেবী হওয়া সত্ত্বেও, হুগলি জেলায় তিনি মন্দিরে থাকেন। সিঁদুরলিপ্ত প্রস্তরখণ্ড দেবীর প্রতীক রূপে পূজিত হয়। ব্রাহ্মণ পুরোহিত সিনি দেবীর পুজো পৌরহিত্য করেন।
সিনি দেবীর নির্দিষ্ট কোনও মূর্তি নেই। মন্দির বা চালা ঘরে দেবী থাকেন না। দেবী বৃক্ষতলে অবস্থান করেন। তবে স্থান বিশেষে ব্যাতিক্রম দেখা যায়। দেবীকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে পূজার্চনা করেন না। তিনি কারও গৃহে থাকেন না। আদপে সিনি দেবী হলেন গ্রাম দেবতা। গ্রামগতভাবেই দেবী পুজো পান। গ্রামের সাধারণ কোন স্থানে বা অপর গ্রামদেবতার থানে অর্থাৎ জাহের থানে সিনি দেবী অবস্থান করে। সিনি দেবীর প্রতীক রূপে পল্লি বাংলায় পোড়ামাটির ঘোড়া, হাতিকে পুজো করার রেওয়াজ রয়েছে। তবে পাকা ধানকেও কোথাও কোথাও সিনি দেবীর প্রতীক হিসেবে পুজো করা হয়।
থানে একটি পাথরের খণ্ড রেখেও সিনি দেবীকে পুজো করার রেওয়াজ রয়েছে। অমসৃণ প্রস্তর খন্ডের উপরে দুটো চোখ অঙ্কন করে তারপর দেবীর আরাধনা করা হয়।
লায়েকেরাই অর্থাৎ দেশীয়রাই এই পুজোয় পৌরহিত্য করেন। কিছু ক্ষেত্রে গ্রামপতিদেরও পুজো করতে দেখা যায়। মাঘের প্রথম দিন, বা ক্ষেত্র বিশেষে মকর সংক্রান্তির দিন সিনি পুজোর আয়োজন করা হয়। এই পুজোর বিশেষ মন্ত্র নেই। দুপুর বেলা পুজো আরম্ভ হয়। পুজাকালে পুরোনো থান ভেঙে ফেলে, গ্রামবাসীরা নতুন বেদী তৈরি করেন। টেরাকোটার হাতি, ঘোড়াগুলোকে ঐস্থানে ঐ দেবীতে স্থাপন করা হয়। পাথর খন্ডের উপর সিঁদুর দিয়ে দেবীর প্রতীকী চোখ আঁকা হয়।
প্রদীপ জ্বালিয়ে পুরোহিত কিছুক্ষণ ধ্যান করেন। হাতি-ঘোড়াগুলির উপরেও সিঁদুর লেপে দেওয়া হয়। পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে দুধ, দই, বাতাসা, চাল, কলা নিবেদন করা হয়। নিরামিষ আমিষ উভয় প্রকার অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়।
গ্রাম বাংলার লৌকিক ইতিহাসে নানান ধরনের সিনি দেবীর কথা শোনা যায়, লোধো সিনি, মদনা সিনি, পঞ্চ সিনি, পদ্ম সিনি, মোড়ো সিনি, ভোদ সিনি, কয়া সিনি, কুমান সিনি, শালবাঁই সিনি ইত্যাদি। বাঁকুড়া জেলায় সিনি দেবীর পুজোর আধিক্য দেখা যায়। বাঁকুড়া জেলার লোকসংস্কৃতি গবেষক মিহির চৌধুরী প্রায় ৯৬টি সিনি দেবতার নাম পেয়েছেন। দীর্ঘ দিন ধরে পুজো চলে আসায়, সিনি পুজোয় নানা ধর্ম মতের ধর্মাচারণ মিশে গিয়েছে, কোথাও গাজনের মতো আগুন সন্ন্যাস করা হয় অর্থাৎ আগুনের ওপর দিয়ে ভক্তরা হেঁটে যায়। কোথাও সংকীর্তন হয়, আবার কোথাও বলিদানের প্রথা রয়েছে। বাঁকুড়ার সিনি পুজোতে লৌকিক ধর্মের সঙ্গে শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মাচারণ মিশে গিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিনি পুজো হয় নীরবে, অনাড়ম্বরভাবে আয়োজন করা হয়। আবার ক্ষেত্র বিশেষে, সিনি পুজো বেশ জাঁকজমকভাবে আয়োজিত হয়। লোক সমাগম হয়। মেলা বসে। পৌষ সংক্রান্তি বা পয়লা মাঘে বাঁকুড়া জেলার বেশীরভাগ সিনি পুজো হয়। আবার মাঘী পূর্ণিমা বা বছরের অন্য দিনগুলিতেও এই সিনি পুজোর আয়োজন করা হয়।
দীঘল সিনি:
বাঁকুড়ার মাজমুড়া গ্রামে মা দীঘল সিনির পুজো করা হয়। গ্রামের উত্তর দিকের একটি মাঠে অবস্থান করা একটি কৃষ্ণ বর্ণের প্রস্তরকে দীঘল সিনি রূপে পুজো করা হয়। উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে মা এখানে শস্য রক্ষাকারিনী রূপে পূজিতা হন। কৃষিক্ষেত্র থেকে সমস্ত ফসল তোলা হয়ে গেলে, মায়ের পুজো করা হয়। বছরে মাত্র একদিনই দেবীর আরাধনা করা হয়।
সোনা সিনি:
বাঁকুড়ার আরেক গ্রাম সোনাতপলে, পলাশ গাছের তলায় নির্দিষ্ট থানে সিনির পুজো করা হয়। গ্রামের নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই সিনি সোনা সিনি নামে পরিচিত। প্রচারণা রয়েছে, প্রস্তর খন্ডের মধ্যে সোনা সিনির মুখ দেখতে পাওয়া যায়। আদপে প্রস্তর খন্ডের খানিকটা অংশের আকার দেখে মনে হয় এ যেন দেবীর মুখমন্ডল। কেউ কেউ বলেন, সোনা সিনি বুদ্ধের মুখের আদলে ঘটিত। কিন্তু এটি কোনভাবেই বুদ্ধ মূর্তি নয়।
বামনি সিনি:
বাঁকুড়া জেলার সবচেয়ে বিখ্যাত সিনি হলেন রানীবাঁধের রাজাকাটা অঞ্চলের ভূড়কুড়া গ্রামের বামনি সিনি। মাঘের পয়লা তারিখে এই পুজোর আয়োজন করা হয়। পুজোতে পায়রা, হাঁস, পাঁঠা ইত্যাদি বলি হয়। বামনি সিনির পুজো পাহাড়ের ওপরে আয়োজন করা হয়। পুজো উপলক্ষ্যে পাহাড়ের পাদদেশে মেলা বসে। ভক্ত সমাগম হয়। বামনি সিনি হলেন অরণ্য দেবী। অরণ্যের হিংস্র পশুর হাত থেকে রক্ষা পেতে এই পুজো।
লদা সিনি:
ওন্দা থানার লোদনা গ্রামে লদাসিনির পুজো করা হয়। গ্রাম দেবতা সিনি এখানে দুর্গার প্রতিকী রূপ হিসেবে পুজো পান।
সোনাই সিনি:
বাঁকুড়ার জুনবেদিয়া পঞ্চায়েত এলাকার সোনাদহ গ্রামের, সোনাই সিনি মাঠে রয়েছে সোনাই সিনি ঠাকুরের থান; সেখানেই সোনাই সিনির পুজো করা হয়। লোক বিশ্বাসে সোনাই সিনি এখানে মা দুর্গার আরেক রূপ। মাঘী পূর্ণিমার দিন সোনাই সিনি মায়ের পুজো হয়। সিনি পুজো উপলক্ষ্যে সোনাদহ, লক্ষ্মীজনার্দনপুর ও বড় কালঝরিয়া, এই তিনটি গ্রাম মিলে আয়োজন করে এই অনুষ্ঠান।
ছেকো সিনি:
বাঁকুড়ার পুরন্দরপুর অঞ্চলের বনকাটা গ্রামের গ্রাম্যদেবী হলেন ছেকো সিনি। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে ছেকো সিনির পুজাপাঠ ও নাম সংকীর্তন হয়। পুজোর দিন বনকাটা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে প্রত্যেকের বাড়িতে রান্না বন্ধ থাকে। পুজোর খিচুড়ি প্রসাদই সবাই গ্রহণ করে। গ্রামের মঙ্গল কামনায় ছেকো সিনি পুজোর আয়োজন। এই সিনির কোনও প্রতিমা নেই। পোড়া মাটির হাতি ঘোড়াতেই প্রতিক রূপে পুজো করা হয়। পুজো উপলক্ষ্যে দুদিন মেলা বসে।
বেড় সিনি:
মকর সংক্রান্তিতে তালডাংড়ার হাড়মাসড়ার খিচকা গ্রামে বেড়া সিনি বা বেড় সিনি ঠাকুরের পুজো করা হয়, পুজোর সঙ্গেই চলে সংকীর্তন। চারদিন ধরে চলে মেলা।
জঙ্গল সিনি:
ছান্দার গ্রামে জঙ্গল সিনি মায়ের থানে দোল পূর্ণিমার দিন এই পুজো হয়। জঙ্গল সিনি মায়ের প্রতীক হিসেবে পোড়ামাটির হাতি ঘোড়ার ব্যবহার করা হয়।
চন্দ্র সিনি:
রাইপুরের গ্রামে কংসাবতী নদীর তীরে একটি গাছতলাতে পয়লা মাঘ চন্দ্র সিনির আরাধনা করা হয়। এখানেও সিনি দেবীর কোনও মূর্তি নেই। পোড়া মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া প্রতীকেই পুজো হয়। এই উপলক্ষ্যে একটি মেলা বসে, এই মেলার মুরগির লড়াই খুবই আকর্ষণীয়।
সিমন সিনি:
সিমলাপালের পার্শ্বলা গ্রামে সিমন সিনি বা সিমল সিনি পুজো হয়। প্রধানত খয়রা সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পুজোর আয়োজক। পয়লা মাঘ সিমন সিনি পুজো হয়। পুজোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল আগুন সন্ন্যাস। অর্থাৎ জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাঁটা। যারা মানসিক করেন, স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে তারা আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যান। এই দেবী গ্রামের দেবী। এই পুজো নিয়ে একটি কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। একদা এই গ্রামের কোন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক নি:সন্তান ব্যক্তি গ্রাম্য পুরোহিতের পরামর্শে এই পুজো করেন। তারপর তার এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সেই থেকেই পুজোর শুরু। সিনি দেবী এখানেও অবয়বহীন, গাছতলাতেই দেবীর থান। পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বলে।
ঝমকা সিনি:
সিমলাপালের দুবরাজপুরের ঝমকা গ্রামে এক গাছতলাতে ঝমকা সিনির পুজো করা হয়। শিলাবতী নদীর তীরে সারা বছর মায়ের থানে পোড়া মাটির হাতি ঘোড়া দিয়ে পুজো হয়। ঝমকা সিনির বিশেষ পুজো হয় ৫ই মাঘ। দুদিন ধরে চলে অনুষ্ঠান, গ্রামীণ মেলা বসে। দ্বিতীয় দিনের বিশেষ আকর্ষণ হল যাত্রা। প্রায় ৭৫ বছর ধরে এই পুজো চলে আসছে। কেবলমাত্র বার্ষিক পুজোর সময় প্রতিমা তৈরি করা হয়। দেবী এখানে দ্বিভূজা এবং ঘোড়ার পিঠে আসীন হন। অষ্টমঙ্গলায় অর্থাৎ আটদিন পরে সিনি প্রতিমার বিসর্জন হয়।
পাথরি সিনি:
পাথরি সিনি হলেন সিমলাপালের মণ্ডল গ্রাম পঞ্চায়েতের পাথরি গ্রামের গ্রাম্যদেবী। জয়পন্ডা নদীর ধারে মায়ের থান। মাঘ শুক্ল পঞ্চমীতে সরস্বতী পুজো হওয়ার দুদিন পরে, সপ্তমী তিথিতে এখানে বার্ষিক পুজো হয়। পূজার দিন রাতে হয় নিশি পুজো, নিশি পুজোতে বলি দান চলে। তারপর দুদিন ধরে যাত্রাপালা চলে।
ঘাঘরা সিনি:
মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি অঞ্চলে তারাফেনী নদী তীরবর্তী ঘাঘরা গ্রামে সিনি পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে। বিপুল জনসমাগম হয়। এই সিনি পুজো গ্রামের নামে ঘাঘরাসিনি পুজো নামেই পরিচিত।
সিনিদেবীদের মধ্যে ঘাঘরাসিনি দেবীই সবচেয়ে বিখ্যাত। একটি প্রস্তর মুন্ড হল দেবীর প্রতীক। সিঁদুর, কাজল আর মেথি দিয়ে পাথরের মধ্যে দেবীর চোখ আঁকা হয়। পুজোর অর্ঘ্য হিসেবে ফল,
চিঁড়ে, গুড় নিবেদন করা হয়। মাতৃবেদীর উপর আরশি, চিরুনি, শাড়ি, সিঁদুরের ঠোঙা, টাঙ্গি, লাঠি দেওয়া হয়। গ্রামপতি ও তার স্ত্রী এই পুজোয় পৌরহিত্য করেন। এখানে পশু বলিরও চল রয়েছে। বলি শেষে নাচ গানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয়েরা এই নাচ গানে অংশ নেন। সন্ধ্যায় আরম্ভ হয়ে সারা রাত উৎসব চলে। পশু বলির পরে, সিনি দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা পশুর মাথাটি পুজোর পৌরহিত্য করা দম্পতি নিয়ে নেন। ভক্তেরা ছোট ছোট মাটির পাত্রে বলির রক্ত নিয়ে দেবীকে উৎসর্গ করেন। এই দিন সিনি দেবীকে বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। আদপে গ্রামপতিই এই কাজটি করে থাকেন। যদিও দেবী স্বয়ং করেন বলেই প্রচার। কোনো সন্তানের জন্ম নিয়ে বা বাবা মায়ের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ- সংশয় থাকলে দেবী নিজেই এ দিন তা দূর করেন বলেই, প্রচলিত বিশ্বাসে মনে করা হয়।
বাংলার লৌকিক দেব-দেবতার ইতিহাসে ঘাঘরাসিনি দেবীর আরেকটি রূপভেদ পরিলক্ষিত হয়। তিনি বনদেবী, ঘাঘরা বুড়ি। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এই ঘাঘরা বুড়ি আর ঘাঘরা সিনি এক এবং অভিন্ন।
সিনি দেবী কেবল কৃষি দেবী নন, তিনি বিপদনাশিনী দেবীও বটে। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, তিনি যে পল্লিতে অবস্থান করেন, সেখানকার সকলকে তিনি বিপদ আপদ এবং বহিরাগত ভূতপ্রেতের হাত থেকে রক্ষা করেন অর্থাৎ সিনি দেবী হলেন গ্রামরক্ষাকর্তী।
এই গ্রাম রক্ষা করার ধারণা আদিম যুগের। আদিম যুগে মনে করা হত, মৃত পূর্বপুরুষ, কোমপতি মৃত্যুর পরে অশরীরী অবস্থায় এসে আমাদের রক্ষা করেন। দুষ্ট আত্মাদের বিতাড়িত করে, গ্রামের লোকেদের মঙ্গল করেন। এই কারণেই মৃত পিতৃপুরুষদের আরাধনা করার রেওয়াজ রয়েছে আমাদের। অনেক লোক সংস্কৃতি ও ইতিহাস গবেষকের মতে, আদিম যুগে পূর্ব-পুরুষদের আরাধনা করার রীতি থেকেই সিনি পুজোর উদ্ভব হয়েছে। এই ধারণা স্পষ্ট হয়, সিনি শব্দের বুৎপত্তি নিয়ে জানলে। সিনিকে অঞ্চল ভেদে সুনিও বলা হয়। আদিবাসীদের মধ্যে সুনিয়া বলে একটি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যার অর্থ আদি বা আরম্ভ। সুনিয়া থেকে সিনির আগমন ঘটলে, তার অর্থ হল আদি। এই আদি পিতৃ পুরুষ বা পূর্বপুরুষদের পুজো হতেই পারে।
সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মতে, সিনি মূলত বৌদ্ধদের দেবতা। ছান্দারের গ্রামদেবী জঙ্গাল সিনিকে বৌদ্ধদের সম্পদের দেবতা জম্বলদেব বলে অভিহিত করা হয়। রাউতখন্ডের জগৎ গৌরী এবং পাঁচালের চুণ্ডা সিনিকেও বৌদ্ধতন্ত্রের দেবী বলে মনে করা হয়। মনে করা হয় এই রাঢ় বাংলায় এক সময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বসবাস ছিল। জনশ্রুতি রয়েছে শুশুনিয়া নামটি বৌদ্ধদের দেওয়া। বৌদ্ধ শব্দ সংসুমারো থেকে শুশুনিয়া শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।
আজ শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছেই অবস্থিত কটরা গ্রামে সেনাপতি পদবীধারীরা ভগবান বুদ্ধের পুজো করেন। সোনামুখীর সুবর্ণমুখী মন্দিরে আজও বুদ্ধের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। বাঁকুড়ার বৈতল গ্রামের ঝগড়াই সিনি বৌদ্ধ দেবাংশী অর্থাৎ দেয়াসী।
বলাইবাহুল্য, রাঢ় বাংলা বৌদ্ধ, জৈন এবং হিন্দু সংস্কৃতির এক অনন্য মিলন ক্ষেত্র, এখানেই আর্য এবং অনার্যরীতির মেলবন্ধন ঘটেছিল। ধৰ্মীয় সংস্কৃতির এই বিনিময় বাংলার লৌকিক দেব-দেবীর ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এইভাবেই বহু ধর্মের মিলনক্ষেত্র রাঢ় বঙ্গে সিনি দেবীর পুজোর প্রচলন হয়েছে, যা কালে কালে সমাজের নানান স্তরে পৌঁছে গিয়েছে।