শক্তি চট্টোপাধ্যায় একসময় রূপচাঁদ পক্ষী ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। পেন নেম। চাইবাসা থেকে কলকাতায় ফিরে ওই নামে কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন। ছদ্ম নামে ব্যর্থ প্রেমের গল্প।
কিন্তু সেকেলে কলকাতা চিনত অন্য এক রূপচাঁদ পক্ষীকে। ব্যঙ্গে, গানে, খেউরে, শ্লেষে যিনি ডুবিয়ে রেখেছিলেন উনিশ শতকের কলকাতাকে। তাঁর গান আয়নার মত। তাতে সমকালের মুখ। সে মুখ কখনও বদলে যাওয়া বাঙালির। কখনও তাতে ছায়া ফেলেছে বাবুয়ানি কিংবা বিবিবিলাস। আগমনী, বিজয়া, বাউল, দেহতত্ত্ব, পাঁচালী, টপ্পা, রাধাকৃষ্ণের গানও ছিল। কিন্তু সব কিছুয়ে ছাপিয়ে গিয়েছিল পক্ষীর শ্লেষ। ঢপ। ব্যঙ্গগীতি।
রূপচাঁদ পক্ষীর আসল নাম রূপচাঁদ দাস। দেশ চিল্কা। উড়িষ্যা। বাবা গৌরচাঁদ দাস মহাপাত্র রাজা হরিহর ভক্তের আমমোক্তার ছিলেন। সেই সূত্রেই কলকাতার বাসিন্দা। রূপচাঁদ ছোটবেলা থেকেই গান বাঁধতে পারতেন। গান টানত তাঁকে। কোম্পানির রেল, গঙ্গার পোল যে কোন নতুন ঘটনা, হুজুগ উঠলেই তা গানে বাঁধতে সময় নিতেন না। হেয়ার স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ছোটে মিয়াঁ, ছুটি খাঁর কাছে গান শিখেছিলেন। রূপচাঁদের সঙ্গীত গুরুর তালিকা ছোট নয়।
গানের আসরে দর্শকদের মাতিয়ে তুলতে জানতেন। সহজাত আমোদে পটু। গান, ভঙ্গিমা সব মিলিয়ে ‘খগপতি’র টান কিছুতেই এড়ানো যেত না।
রূপচাঁদের সব লেখায় ‘পক্ষী’ বা ‘খগরাজ’, ‘খগবর’, ‘খগপতি’র ভনিতা থাকত। রূপচাঁদ গানে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন।
বেজায় রসিক মানুষ ছিলেন রূপচাঁদ। একটা দল গড়ে ছিলেন। ‘পক্ষীর জাতিমালা’। ‘পক্ষীদল’ নামেও মানুষ চিনত। দলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বাগবাজারের নামকরা বাবু শিবকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়।
গান জনপ্রিয় হবার পর ঠেলাগাড়ির ওপর একটা খাঁচা তৈরি করিয়েছিলেন। সেই গাড়ির ভিতর বসে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গান চলত। এভাবে কলকাতার নামী লোকজনের বাড়ি, আখড়ায় ঘুরে বেড়াতেন। পক্ষীদলের সদস্যদের পাখির নামে, পাখির ডাকে ডাকনাম দেওয়া হত। গানের সঙ্গে তাদের গঞ্জিকাপ্রীতির গল্পও ফিরত মুখে মুখে।
রূপচাঁদপক্ষীর গান এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে ভিখারিদের গলাতেও ফিরত রূপচাঁদ পক্ষীর গান।
"লেট মি গো ওরে দ্বারি,
আই ভিজিট টু বংশীধারী।
এসেছি ব্রজ হতে, আমি ব্রজের ব্রজনারী।।
বেগ ইউ ডোরকিপর লেট মি গেট।
আই ওয়ান্ত সি ব্লক হেড,
ফর হুম আওয়ার রাধা ডেড,
আমি তারে সার্চ করি"...।
রূপচাঁদের জীবদ্দশায় ওঁর দুশো এগারোটি গান নিয়ে ‘সঙ্গীত রসকল্লোল’ নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।