দিক শূন্য জীবনে একদিন এক মরণাপন্ন ভিখারিকে জল পান করিয়েছিলেন৷ সে সময় নিজেও একই পরিচয়ের ভাগীদার। ঘুরে যায় জীবনের চাকা৷ সেদিন সমাজসেবাকেই বেছে নিলেন জীবনের একমাত্র ব্রত হিসাবে৷
যে নরম হাতে বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টানোর কথা, সেই হাত শক্ত হয়েছে গরু বাছুর চড়িয়ে। হলেন বাল্য বিবাহের বলি মাত্র দশ বছর বয়সে। স্বামী কুড়ি বছরের বড়ো।উনিশ বছর হতেই গর্ভে তিন সন্তান। কুড়ির গণ্ডি পেরোতেই শুনলেন প্রথম মা ডাক। যৌতুকের পণ দিতে না পারায় বিতাড়িত হলেন স্বামীর ঘর থেকে।
সমাজ কপালে এঁটে দিলো দুশ্চরিত্রার তকমা। এদিকে স্বামীর মারের আঘাতে সংজ্ঞাহীন তিনি। গোয়ালঘরে যখন তাকে টেনে হিঁচড়ে আনা হলো তখন তিনি সন্তানসম্ভবা। সেই গোয়ালঘরেই তাঁর কন্যা সন্তানের প্রসব হয়। নিজের নাড়ী কাটেন নিজেই।
স্বামীর ঘর ছেড়ে উঠলেন বাবার আশ্রয়ে। ব্যস! অমনি সমাজ কড়া নাড়ছে দরজায়। শশ্মাণ হলো নতুন ঠিকানা। শবদেহ পোড়ানোর পর কিছু খাবার ছিটিয়ে দেওয়া হতো। সেসব খেয়েই পেটের দাবী মেটাতেন। একসময় পরিচিত হলেন শ্মশান ভূত নামে।
আর না পেরে উঠে ঠিক করলেন বেঁচে থাকার কোনও মানেই নেই। লাইনে মাথা রাখলেন। সেদিন আবার রেল ধর্মঘট। মৃত্যুও তাঁকে যেন আগলে রেখেছে। আবার ফিরে আসলেন শ্মশানে। পরের সপ্তাহে আবার। ছেলেমেয়েকে আঁচলে আঁকড়ে শুয়ে পড়লেন রেললাইনের ওপর।
এমন সময় কানে এলো প্রচণ্ড কান্নার শব্দ। দেখেন গাছের নীচে একটা বাচ্চা কাঁদছে। শিশুটি যে গাছের ছায়ায়, তার একটা ডাল ভাঙা। সেই ভাঙা ডালেই আবার পাতার বাহার। ফুলের কাকলি।
ভেঙে যেতে যেতে টিকে থাকা গাছে যদি পাতা গজায়, ফুল ফোটে; সেই গাছের ডাল আবার ছায়া দিয়ে মানুষকে আশ্রয় দেয়, তবে তাঁর এই জীবনটা কি শুধুই অর্থহীন। আসলে সেসব ছিল আগামীর ইঙ্গিত।
এক হাতে ছেলে আরেক হাতে মেয়েকে নিয়ে তিনি রেলস্টেশনে আসলেন। ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজে খাওয়ালেন। পেলেন না কর্মের হদিশ। স্টেশানে গান গেয়ে গেয়ে শুরু করলেন ভিক্ষা। আয়ের টাকা দিয়ে খাবার কিনে রাতে রান্না করতেন। শুধু নিজের সন্তানই নন, রেলস্টেশনে ঘুমিয়ে থাকে অন্যান্য অভুক্ত শিশুদেরও পেট ভরাতেন। গাইতেন ঘুম পাড়ানীয়া গান।
অনাথ শিশুগুলোও যেন তাদের মাকে খুঁজে পেলো। মাতৃত্বের সঞ্চয় তাঁকে তখন বিশ্বজয়ী করে তুলেছে। একদিন একটি ব্রিফকেস খুঁজে পেয়ে স্টেশান মাস্টারের অফিসে জমা দেন। কয়েক সপ্তাহ পর এক লোক দেখা করতে এসে তাঁকে উপহার দিতে চান। তিনি বলেন- কোনও উপহার চাইনা। শুধু আমার শিশুদের নিয়ে থাকার জন্য একটা ছাত... শুরু হলো জীবনের আরেকটি অধ্যায়।
এই বাড়িই তখন অনাথদের স্বর্গ। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। শিশুদের প্রতি তাঁর এই ভালোবাসা দেখে অন্যান্য মানুষেরাও এগিয়ে আসলেন। ঘর বড় হলো। একদিন দেখেন একজন বৃদ্ধ তাঁর কাছে এসে আশ্রয় চাইছেন। ভাত, রুটি যাই থাকুক না কেন এতোটুকু খাবার চাইছে। বৃদ্ধ লোকটিকে তিনি আশ্রয় দিলেন। গায়ের জামা বদলে দিলেন। খাবার খাওয়ালেন। ডাক্তার এসে তাঁর শরীর চেক করে ওষুধ খাইয়ে গেলেন। বৃদ্ধ লোকটি তখনও আনমনা।
সকলের মা বলে উঠলেন - " একদিন তুমি এক সন্তানসম্ভবা মেয়েকে মেরে গোয়ালঘরে ফেলে রেখেছিলে। কিন্তু বিধাতার কী নিয়ম দেখো- আজকে তুমি সেই মেয়ের কাছেই আশ্রয়ের জন্য এসেছো। শশ্মানে শবের অপেক্ষায় থেকে দুমুঠো খাবারের জন্য যার জীবনে কেটেছে-সে জানে ক্ষুধার দুঃখ কী। সে জানে- মাথার উপর একটু আশ্রয় প্রাপ্তির সুখ কী। তাই তুমি সব কিছুই এখানে আমার কাছে পাবে। কোনো অবহেলা পাবেনা। কিন্তু আর আমার স্বামী হিসাবে না বরং আমার সন্তান হিসাবেই এখানে থাকবে। "
পুরো পৃথিবীতেই তিনি নানান সম্মান, খ্যাতি এবং প্রায় ৭৫০ রকমের এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। "মাদার ওব থাউজেন্ড অরফানস" নাম নিয়ে তিনি রোজই সামাজিক মাধ্যমের ট্রেন্ডিং টপিক।
গোয়াল ঘরে জন্ম নেয়া মেয়েটি চিকিৎসক হয়ে সব অনাথ শিশুদের চিকিৎসার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। তাঁর অনাথালয় থেকে শত শত নামহীন শিশু ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার হয়ে শুধু ভারতে না, বিশ্বের নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন।এই মহিয়ষী এবার করোনার এই প্রকোপের সময় যাতে একজন মানুষও অভুক্ত না থাকেন তাঁর এলাকায়, তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
ও এখনও নামটাই তো বলা হলো না! তিনি সিন্দুতাই শেপকাল। এখন ২৪৩ জন ছেলে মেয়ের শাশুড়ি৷ তাঁর নাতি নাতনির সংখ্যা ১০৫০৷ ‘মি সিন্ধুতাই শেপকাল’, আমি সিন্ধুতাই শেপকাল নামে তাঁর জীবনী নিয়ে মারাঠি ছবি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে।
১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা -র এক মেষপালকের ঘরে জন্ম সিন্ধুর৷ আজও বিশ্বাস করেন ত্যাগের একটা ছোট মুহূর্তও জীবনের বড়ো সঞ্চয় হতে পারে। এক গাল চওড়া হাসিতেই তিনি ট্রেন্ডি। সুন্দর জামাকাপড় বা অলঙ্কার বলতে তাঁর কাছে জায়গা পায় মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুন্দর মনটা, এই জগৎ এর এক অনন্য সৃষ্টি।