শীতল ষষ্ঠীর উপাখ্যান

বেনের বউ পোয়াতি। বেচারীর গতিক কিন্তু ভালো না। যা খায়, অমনি বমি হয়ে সব উঠে যায়। খাবার আর পেটের ভেতর তেষ্ঠোবার অবসর পায় না। কাজেই দিনকে দিন দেহটি তার রুগ্নসুগ্ন হয়েই চলল।

বেনে বেজায় বড়লোক। বদ্যি-সদ্যি কতকিছু করল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। দুশ্চিন্তার মেঘ কোনমতেই কাটতে চাইল না। দুঃখেরও আর কিনারা রইল না।

তাই দেখে শীতলষষ্ঠী ঠাকরুণের এবার দয়া হল। তিনি বুড়ি বামনির রূপটি ধরে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে বেনের বাড়ি হাজির হলেন। বললেন, ও বউ, সাজো খাবার না-খেয়ে বাসি খাবার খেয়ে দ্যাখ দিকি! বোধ হচ্ছে, তাতেই তোর বমির ব্যামো সারবে। আর কি বোধ হচ্ছে জানিস?

বেনের বউ বুড়িকে গড় করে বলল, কী মা?

বুড়ি বললেন, বোধ হচ্ছে, তোর কোলে নির্ঘাত কন্যে আসছে! আর সে নিশ্চিত পেটের মধ্যিই মা শেতলষষ্ঠীর বেরতো (ব্রত) শুরু করেছে। তাই বাছা পেটে তোর সাজো খাবার ঠাঁই পাচ্ছে না!

তাই তো তাই। বুড়ির কথা মাথায় নিয়ে বেনের বউ আগের দিন ভাত রাঁধল। ফ্যান ঝাড়ল। তারপর তাতে জল ঢেলে রেখে দিল। সাজো বা টাটকা রাঁধা পদব্যঞ্জন রেখে দিয়ে বাসি করল। তারপর পরদিন তাই-ই টুকুন টুকুন করে খেল। ওমা, সত্যিই তো বাসি খেতেই আর বমি হল না! তখন সকলের দুর্ভাবনা ঘুচল, বেজার মুখে হাসি ফুটল। বেনের বউ মা শীতল ষষ্ঠীর উদ্দেশে সাষ্টাঙ্গে নমো করে নিত্যি নিত্যি বাসি খাবার খেতে লাগল। এমনি করে দিন গেল।

তারপর গভভো দশ মাস পুরতেই বেনে বউয়ের কোল আলো করে সত্যি সত্যিই একদিন কন্যেরত্ন জন্ম নিল। জন্ম নিয়েও সে-কন্যের ব্রত বুঝি মিটল না। সাজো খাবার তার মুখে দিলেই সে বমি করে, বাসি দিলে কিচ্ছু হয় না। তাই তো তাই। তেমনি করেই খেয়েদেয়ে কন্যে বড় হতে লাগল। শেতল খাবার খেয়ে মানুষ আর গভভো থেকেই মা শীতল ষষ্ঠীর ব্রত শুরু করেছে বলে, কন্যের নাম হয়ে গেল, 'শীতুলি'।

তা শীতুলি একদিন বড় হল। রূপেগুণে দশদিক আলো করল। তখন বেনে আর বেনে বউ দেখেশুনে বেশ ভালো ঘরে তার বিয়ে দিল। শীতুলির শাশুড়ি আগেই গত হয়েছে। তাই বেনে বউ বেয়াইকেই বলল, বেয়াইমশাই, শীতুলি আমার বাসি খাবার খেয়েই মানুষ। সাজো খাবার খেলেই অনর্থ হয়। দেখবেন, কেউ যেন তাকে ভুল করেও সাজো খাবার না-খাইয়ে ফেলে!

বেয়াই হেসে বলল, দেখুন বেয়ান, ঘরে শাশুড়িও নেই, ননদও নেই! সংসার তো বৌমার। তার হাতেই হেঁশেল, তার হাতেই হাতা। সাজো খেলে সাজো খাবে, বাসি খেলে বাসি খাবে, তার আর কী!

কাজেই, শ্বশুরের ভিটেয় নতুন বউ হয়ে এসেই শীতুলির আঁচলে চাবির গোছা উঠল, গিন্নিবান্নির খাতির হল। আর কী চাই! শীতুলি রাঁধতে লাগল, বাড়তে লাগল। স্বামী-শ্বশুরকে সাজো খাবার দিয়ে নিজে বাসি খেতে লাগল। এমনি করেই দিন কাটতে লাগল।

তারপর বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই শীতুলির গর্ভ হল।

তখন দশ মাস চলছে। একদিন সকালে শীতুলি যেই না গেল ভাঙা কুলোয় ছাই ফেলতে, অমনি সুরুৎ করে ছাইয়ের গাদায় একখানা কুমড়ো প্রসব করে ফেলল। তা থেকে বেরিয়ে এল খুদে খুদে ষাটখানা পুত্র। তাই দেখে শ্বশুরমশাই তো হাঁ হাঁ করে উঠলেন। ছুটলেন একখানা আঁতুড় গড়তে। অমনি শীতুলি আব্দার ধরল, উঁহু, একখানায় তো হবে না, বাবা! গড়লে, ষাট ছেলের জন্য ষাটখানা আঁতুড় গড়তে হবে। তাই তো তাই।

ক্রমে ক্রমে ছেলেদের ব্যাপারে শীতুলির আব্দারের আর অবধি রইল না। সেই আব্দারে সায় দিয়ে শ্বশুরও ষাট ছেলের জন্য ষাটটি ধাই আনালো। ছেলেদের অন্নপ্রাশনের সময় ষাটটি নাপিত, ষাটটি পুরুত ডাকালো। পড়ানোর জন্য ষাটটি পণ্ডিত। খাওয়ানোর জন্য ষাটটি চাকর। চড়ার জন্য ষাটটি ঘোড়া। থাকার জন্য ষাটটি কোঠারও ব্যবস্থা হল।

এমনি করে ছেলেরা একদিন বিয়ের যুগ্যি বড় হল। তখন শীতুলি আবার শ্বশুরের কাছে গিয়ে আবদার ধরল যে, তার ভারি সাধ ছেলেদের বিয়ে দেয় এক গভভের ষাটটি কনের সনে। তাই তো তাই।

শ্বশুর লোক নিয়ে লস্কর নিয়ে হৈ হৈ করে কনে খুঁজতে বেরোল। কিন্তু দেশ ঘুরে বিদেশ ঘুরে ভারি হতাশ হল। এক মায়ের ষাটটি কন্যে কোথাও খুঁজে পেল না। এদিকে বৌমাকে কথা দিয়েছে, কনের সন্ধান না-নিয়ে ফেরেই বা কেমন করে! তাই চলতে লাগল চলতেই লাগল। একদিন ঘুরতে ঘুরতে দারুণ তেষ্টায় কাতর হয়ে একটি পুকুরের পাড়ে এসে যেই না বসেছে, অমনি একটি দৃশ্য দেখে তেষ্টা-মেস্টা সব ভুলে গিয়ে একশা হয়ে গেল। দেখল, একটি বুড়ি ষাটটি কন্যেকে পুকুরে নিয়ে আসছে নাওয়াতে। অমনি বুড়িকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ গো, এরা কারা?

বুড়ি বলল, আর বলো না বাছা, এরা আমার ষাট নাতনি। এক মায়ের যমজ ছানা।

এই কথা শুনে শীতুলির শ্বশুর তো একেবারে আহ্লাদে আটখানা, বলো কী! তা তোমার নাতনিদের আমায় দাওনা গো, আমার ষাট নাতির সঙ্গে বিয়ে দি!

কথাটি শুনেই বুড়ি যেন হাতে মস্ত চাঁদ পেল। একগাল হেসে বলল, সে তো বেশ ভালো কথা। শুভ দিন দেখে হাতে হাতে মিলিয়ে দিলেই হল! তার আগে বাপু ঘরে এসো, কুটুম্বিতে করি!

ব্যস, দুই বাড়িতে কুটুম্বিতে করে শুভ দিনে বেশ ধুমধাম করে শীতুলির ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেল। বৌমাদের বরণ করে সে ঘরে তুলল। ভারি নিশ্চিন্ত হয়ে সোনার পালঙ্কে গা, আর রুপোর পালঙ্কে পা দিল। তারপরও অবিশ্যি তার গলায় খানিক আফসোস ঝরে পড়ল, এতদিন ধরে সব শখ-সাধই তো পূরণ হল, তবু একটা সাধ যেন রয়েই গেল!

ছেলেরা সেই কথা শুনতে পেল। তারা অমনি ছুটে এসে একসুরে বলল, কী সাধ মা?

শীতুলি বলল, একদিন গরম গরম ভাত মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে মেখে খেতে পারলে মনে হয়, সব শখ-সাধ পূর্ণ হয়!

তার মুখের কথা খসতে-না-খসতেই ছেলেরা মাগুর মাছ এনে হাজির করল। বৌমারা কেটেকুটে রান্না করে ফেলল। তারপর গরম গরম ভাতের সঙ্গে পঞ্চব্যঞ্জন আর মাগুর মাছের ঝোল বেড়ে দিল। শীতুলি সোহাগী হয়ে হাপুস হুপুস শব্দ করে বড় তৃপ্তি করে খেল। আর এসব খেয়েও কী আশ্চর্য, তার বমি হল না!

সে না-হোক, তার মহাসর্বনাশ ঘটে গেল। হঠাৎ করে ছটফটিয়ে গোয়ালের গাই মরল, গরু মরল, ঘরের ভেতর ষাট পুত্র মরল, ষাট বৌমা মরল। শীতুলি নির্বংশ হল! এতবড় আঘাতে বুক চাপড়ে শীতুলি শুরু করল আছাড়ি-পিছাড়ি কান্না! কাঁদতে কাঁদতে তার মনে পড়ল মা ষষ্ঠীর কথা। হুকুড়তে-দুকুড়তে ছুটল মায়ের থান। গিয়ে মায়ের থানে মাথা কুটতে লাগল।

তার এমন পাগলপারা অবস্থা দেখে আর থাকতে না-পেরে মা শীতল ষষ্ঠীরূপে দেখা দিলেন। বললেন, মাথা কুটে আর কী হবে বাছা। একে মাঘ মাস, তায় শুক্লা ষষ্ঠীর দিন, এ-দিনটা যে আমার দিন, তাও ভুলে গেলি! এ-দিনই তোকে সাজো খাবার আর আমিষ্যি খেতে হল! ব্রত রেখে ছানা পেলি, নিজের দোষে সব হারালি! এখন আমি আর কী করি বল!

শীতুলি চোখের জলে মা ষষ্ঠীর পা ধুইয়ে বলল, আমি ভুল করেছি মা। আমায় এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। আমার বাছাদের তুমি ফিরিয়ে দাও মা। আর কক্ষনো এমন ভুল করবো না গো মা...আর কক্ষনো করবো না...

মায়ের পা ধরে শীতুলি এমন কান্না কাঁদতে লাগল যে, মা শীতল ষষ্ঠীরও ভারি কষ্ট হল। বললেন, মায়ের পেট থেকে তুই আমার ব্রত করে আসছিস, তোর মতো ব্রতীনি ত্রিসংসারে নেই। তাই তোর সব অপরাধ ক্ষমা করলুম মা। ঘরে গিয়ে দেখবি, কেউ মরেনি। সক্কলে আগের মতোই বহাল রয়েছে...

এ-কথা শুনে শীতুলির যেন প্রাণে প্রাণ এলো। চোখের জল মুছে সে বলল, তাই যেন হয় মা...তাই যেন হয়...

তারপর মা শীতল ষষ্ঠীর চরণে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে ঘরে ফিরল।

ঘরে ফিরে দেখল, আগের মতোই গোয়ালে গাই-গরু জাবর কাটছে। ছেলে-বৌরা কলকলিয়ে ঘর আলো করে আছে। তখন তার আনন্দের আর অবধি রইল না।

এবার সে বৌমাদের ডেকে প্রথমে মা শীতল ষষ্ঠীর মাহাত্ম্যকথা বলল। তারপর ব্রত করতে শেখাল। দেওয়ালে মা ষষ্ঠীর সঙ্গে ছানাপোনাদের ছবি এঁকে ধান-দুব্বো দিয়ে শিল-নোড়ার পুজো করল। তারপর তাতে দইয়ের ফোঁটা এঁকে সেই দই ছিটিয়ে দিল নৈবেদ্যে। দেবীর নৈবেদ্য আগের রাতে বানানো ঠাণ্ডা গোটাসেদ্ধ (গোটা মুগ ও আরও পাঁচরকম গোটা কলাই, তায় গোটা শিম, আলু, কুলিবেগুন, কড়াইশুঁটি, শীষ পালং, সজনে ফুল, কুল এবং গোটা মশলা দিয়ে একত্রে সেদ্ধ), শীতল পিঠে। পুজোর পর সে-সব প্রসাদ হল। সারাদিন উনুন না-জ্বালিয়ে প্রসাদ খেয়ে দেবীর আরাধনায় দিন কাটালো। আর তাতেই দেবী শীতল ষষ্ঠীর সুদৃষ্টি আজীবন বজায় রইল শীতুলির সংসারে। দেবীর কৃপায় তার নাতিপুতি-বৌমারা ভরা সংসার নিয়ে দেবীর ব্রতাচারের মধ্য দিয়ে পরম সুখে দিন কাটাতে লাগল...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...