সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনি

অশ্বপতি নামে মদ্রদেশে এক রাজা ছিলেন। তাঁর স্ত্রী মালবী। রাজা-রানী নিঃসন্তান ছিলেন। সন্তানলাভের জন্য বহু চেষ্টা করেন তাঁরা, কিন্তু ব্যর্থ হন। সন্তানের প্রত্যাশায় একবার তাঁরা সাবিত্রীদেবীর অর্চনা করলেন। সাবিত্রীদেবী তাঁদের আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে বর দিলেন এক কন্যা সন্তানের। যথাসময়ে সন্তানবতী হলেন রানী। দেবীর বরে কন্যা সন্তান হল তাঁদের। সূর্যের অধিষ্ঠাত্রী সাবিত্রীদেবীর বরে জন্ম বলে কন্যার নাম রাখা হল ‘সাবিত্রী’।

দেখতে দেখতে বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠলেন রাজকুমারী সাবিত্রী। অশ্বপতি কন্যার জন্য উপযুক্ত পাত্রের অন্বেষণ করতে বললেন। একদিন রাজ কুমারী সাবিত্রী পিতাকে জানালেন, শাল্ব দেশের দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবানকে মনে মনে স্বামী হিসেবে বরণ করেছেন তিনি।

এদিকে দ্যুমৎসেন তখন অন্ধ। রাজপাট সব খুইয়ে বনবাস করছেন। মেয়ের কথায় তাই রাজা অশ্বপতি খুব সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। অশ্বপতির সভায় উপস্থিত ছিলেন দেবর্ষি নারদ। তিনি নারদের মত জানতে চাইলেন। নারদ জানালেন, দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবান সুদর্শন, সত্যবাদী, দাতা ও ব্রাহ্মণসেবী। পাত্র হিসেবে গুণী। কিন্তু তার আয়ু আর এক বছর। এক বছর পরই তার অপঘাতে মৃত্যু ঘটবে।

অশ্বপতি সে কথা শ্রবণ করে ারও হতাশ হয়ে পড়লেন। কন্যাকে অন্য পাত্রকে বরণ করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু সাবিত্রী কোনভাবেই রাজি হলেন না।

রাজকন্যা সাবিত্রী জানালেন, ‘মনে মনে সত্যবানকেই স্বামী হিসেবে বরণ করেছেন। তিনিই তাঁর স্বামী’। পিতাকে বললেন,  ‘গায়ের অলঙ্কার পছন্দ না হলে ফেলে দেওয়া যায়, কিন্তু মনের অলঙ্কার কী করে ফেলব, পিতা? আমি বহুচারী হতে পারবো না’।

কন্যার যুক্তি মেনে নেন অশ্বপতি। সত্যবানের সঙ্গেই সাবিত্রীর বিয়ে হল। সাবিত্রী হিসাব রাখছিলেন, কখন এক বছর পূর্ণ হয়। যখন একবছর পূর্ণ হতে আর চার দিন বাকী তখন তিনি উপবাস শুরু করলেন।

যে দিন সত্যবানের মৃত্যুর দিন সেদিন সাবিত্রী সত্যবানের সঙ্গে সঙ্গে থাকলেন প্রতি মুহূর্ত। সে দিন সত্যবান বন থেকে কাঠ ও ফলমূল সংগ্রহ করতে বনের গভীরে যাচ্ছেন দেখে সাবিত্রীও তাঁর সঙ্গ নিলেন। এক মুহূর্তের জন্যও তাকে চোখের আড়াল হতে দিলেন না।

কাঠ কাটতে কাটতেই সত্যবান অসুস্থ বোধ করলেন। বললেন, প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে তাঁর। সাবিত্রী সত্যবানকে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তে বললেন। সত্যবান তাই করলেন। দু’চোখ বন্ধ। তখন এক ভয়ঙ্কর পুরুষ এসে একহাতে সত্যবানের প্রাণ আর হাতে প্রাণহীন দেহ নিয়ে চলতে শুরু করলে সাবিত্রীও কোন কথা না বলে তাঁর পিছু পিছু চলতে শুরু করলেন।

যম সাবিত্রীকে বললেন যে, স্বামীর প্রতি ওঁর যা কর্তব্য তা সম্পন্ন হয়েছে, এখন বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু সাবিত্রী থামলেন না। যমকে বললেন, স্বামীছাড়া কোন নারীর পক্ষে নির্জন বনে ধর্ম মেনে চলা সম্ভব না। তারপর তিনি যমকে ধর্মকথা শোনাতে লাগলেন। যম তাতে তুষ্ট হয়ে সত্যবানের জীবন ছাড়া আর যে কোনও বর চাইতে বললেন। সাবিত্রী তখন যমের কাছে তাঁর শ্বশুরের অন্ধত্ব দূর করে দিতে বললেন। যম সেই বর দিয়ে ক্লান্ত সাবিত্রীকে ফিরে যেতে বললেন।

কিন্তু সাবিত্রী চলতেই থাকলেন। বললেন যে, প্রাণপতির কাছাকাছি থাকলে কোন স্ত্রী কখনও ক্লান্ত হয় না। এছাড়া যম সজ্জন, সুতরাং উনি সাধুসঙ্গ করছেন। যম তখন তুষ্ট হয়ে পতির জীবন ছাড়া আরেকটি বর দিতে চাইলেন। সাবিত্রী এবার বর চাইলেন শ্বশুরের রাজ্য উদ্ধার হোক। যম সেই বর দিলেন।

কিন্তু তবুও ফিরে গেলেন না সাবিত্রী। যমকে সনাতন ধর্মের কথা শোনালেন। যম তাতে সন্তুষ্ট হয়ে সাবিত্রীকে পতির জীবন ছাড়া অন্য কোনও বর চাইতে বললেন। সাবিত্রী বললেন যে, সত্যবান না থাকায় এখন ওঁর পিতা পুত্রহীন - তাঁর যেন শতপুত্র হয়। যম বর দিয়ে সাবিত্রীকে ফিরে যেত বললেন।

সাবিত্রী বললেন, এটা আমার কাছে দূর নয়, আমি আমার স্বামীর সাথে সাথেই রয়েছি।

তারপর যমের প্রশংসা করে বললেন যে, যম সমবুদ্ধিতে প্রজাশাসন করেন বলে তিনি ধর্মরাজও। যম হলেন সজ্জন। নিজের চেয়েও সজ্জনদের উনি বেশি বিশ্বাস করেন। সুতরাং নিজের ক্ষতি নিয়ে তাঁর কোন দুশ্চিন্তা নেই। যম খুশি হয়ে বললেন, সত্যবানের জীবন ছাড়া তিনি আরেকটি বর দিতে চান। সাবিত্রী এবার চাইলেন, ‘আমার গর্ভে যেন সত্যবানের ঔরসে বলশালী শতপুত্র হয়’। যম সাবিত্রীর প্রার্থিত বর দিয়ে বললেন, ধর্মকন্যা, এবার ফিরে যাও। কিন্তু সাবিত্রী তাঁর সঙ্গ ছাড়লেন না।  তাঁকে ধর্মকথা শোনাতে লাগলেন।

যম খুব সন্তুষ্ট হয়ে আর একটা বর দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সাবিত্রী বললেন, ‘সত্যবান জীবন লাভ করুন। পতিহীনা হয়ে আমি বাঁচতে চাই না।’ যম খুশি হয়ে সেই বর দিয়ে সত্যবানকে রেখে চলে গেলেন।

প্রাণ ফিরে পেলেন সত্যবান। জয় হল সাবিত্রীর নিষ্ঠার।

এই কাহিনি মনে রেখে হিন্দু নারীরা স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায় সাবিত্রী ব্রত পালন করেন। বিবাহিত নারীরা বটবৃক্ষের পুজো করে। বটবৃক্ষকে চিরঞ্জীবী বলা হয়। তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশের বাসস্থান বটবৃক্ষ। হিন্দু বিশ্বাস মাতা লক্ষ্মী সর্বদা বিরাজ করেন বটবৃক্ষে। তাই বটগাছের পুজো করলে স্বামীর দীর্ঘায়ু লাভের পাশাপাশি কষ্টমুক্ত, রোগমুক্ত, ভয়মুক্ত হওয়ার বর পাওয়া যায়।

বিবাহিত মহিলারা স্নান করে বটগাছে রুলি ও চন্দনের তিলক লাগায়। একটি কাঁচা সুতো বেঁধে বটগাছটি পাঁচ থেকে সাত বার প্রদক্ষিণ করে।

জ্যৈষ্ঠ মাসে সাবিত্রী চতুর্দশী ব্রত পালন করা হয়। এই দিন শাশুড়িদের উপহার দেন পুত্রবধূরা। আম তরমুজের মতো মরসুমী ফলের সঙ্গে তালপাতার হাতপাখা উপহার দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। ছোলা খেয়ে এই ব্রত সমাপন হয়।   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...