সন্ধিপুজো, দেবী এ'সময় অসুর নিধন করেছিলেন। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে হয় সন্ধিপুজো। অষ্টমীর শেষ এক দণ্ড এবং নবমীর প্রথম এক দণ্ড, মোট দু-দণ্ডর পুজো। দণ্ডর হিসেবটা করে ফেলি, গোটা একটা দিনে থাকে আটটি প্রহর। অর্থাৎ এক একটি প্রহর হল তিন ঘন্টা। মোট ১৮০ মিনিটি। আবার এক প্রহরের সাড়ে সাত ভাগের এক ভাগ হল এক দণ্ড। কী দাঁড়ালো? ১৮০÷৭.৫ = ২৪। ২৪ মিনিটে এক দণ্ড। সন্ধিপুজো হয় ৪৮ মিনিটের। এক্কালে এক দণ্ড সময় পরিমাপ করতে ‘তাঁবি’ বসানোর প্রথা ছিল।
মনে হয় তামার বাটি থেকে তাঁবি শব্দটা এসেছে। খুব ছোট্ট ছিদ্রযুক্ত একটি গোল তমার বাটি, জলভর্তি বড় একটা মাটির হাঁড়িতে বা ধাতব বড় গামলা গোছের পাত্রে বসিয়ে দেওয়া হত। একটু একটু করে তামার বাটিতে জল আসে। আর আস্তে আস্তে তামার বাটি ডুবতে আরম্ভ হয়। পুরোটা ডুবে যেতে সময় লাগে এক দণ্ড। এইভাবেই ডোবা দেখে দণ্ডের পরিমাপ করা হত। আজও কোনও কোনও বনেদি বাড়িতে এই চল রয়েছে।
দুর্গাপুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল সন্ধিপুজো কিন্তু এমন বাড়িও রয়েছে যেখানে সন্ধিপুজো হয় না। মানিকতলার ঘোষবাড়ির দুর্গাপুজোয় সন্ধিপুজো হয় না। সিপাই বিদ্রোহের আগের বছর, অর্থাৎ ১৮৫৬ সাল থেকে এ বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। গিরিশচন্দ্র ঘোষের হাতে পুজোর সূচনা। এখানে সন্ধিপুজো হয় না। শোনা যায়, কোনও এক বছর ঘোষ বাড়ির গুরুদেব সন্ধিপুজো চলাকালীন মারা যান। তার পর থেকে সন্ধিপুজো বন্ধ। তার বদলে পরিবারের সকলের কল্যাণে আয়োজিত হয় কল্যাণী পুজো। এই পুজোতে ১০৮ প্রদীপ জ্বালানো হয়। অষ্টমীর আরতির সময় ৩৬৫টি প্রদীপ জ্বালানো হয়। বছরের ৩৬৫ দিনের সন্ধ্যাবাতির প্রতীক হিসেবে এই রীতি পালন করে চলেছে ঘোষবাড়ি। কোনও কারণে কোনওদিন সন্ধ্যায় বাতি না পড়লে যাতে বিঘ্ন না ঘটে তার জন্যই এই আচার। সন্ধিপুজো যেমন হয় না, তেমনই এ বাড়িতে সিঁদুর খেলাও হয় না। এই পরিবারের প্রতিমাতেও একটি বিশেষত্ব দেখা যায়। এদের বাড়ির লক্ষ্মী, সরস্বতীর বাহন থাকে না। দুর্গা, সরস্বতী ও লক্ষ্মীকে ত্রিদেবী হিসেবে পুজো করা হয়। একই দেবীর তিন রূপ। বাহন কেবল একটিই সিংহ।
সন্ধিপুজোয় পদ্ম ফুল আবশ্যক। কিন্তু কলকাতার এক বাড়িতে ১০৮ অপরাজিতায় সন্ধিপুজো করা হয়। উত্তর কলকাতার নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের মিত্র বাড়ির সন্ধিপুজো পদ্মফুলে নয়, ১০৮টি অপরাজিতা ফুলে সন্ধিপুজো হয়। নৈবেদ্যতে কুলের আচার, আট রকমের বড়ি দেওয়া হয়। প্রথম কুল ওঠার পর সেই কুল দিয়ে আচার বানিয়ে রাখা হয় মায়ের জন্য।
বড়শুলের দে রাজবাড়িতে সন্ধিপুজোর সময় বাড়ির সমস্ত বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। ৫০০ বছরের পুরনো রানাঘাটে চৈতন্যচরণ ঘোষের পুজোয় অষ্টমী তিথিতে লক্ষী জনার্দনের পুজো হয় দুর্গা দালানে। দামোদরের তীরবর্তী নবখণ্ড গ্রামে আবার শালুক ফুল ছাড়া সন্ধিপুজোর আগে বলি হয় না। সন্ধিপুজোয় বলির আগে খাঁ পরিবারের কোনও এক সদস্য নির্দিষ্ট পুকুর থেকে ডুবে দিয়ে একটি সাদা শালুক ফুল তুলে আনেন। এক ছুটে সেই ফুল মন্দিরে নিয়ে যেতে হয়। সাদা শালুকের তিনটি পাঁপড়ি রক্ত চন্দন মাখিয়ে রাখা হয় দেবী দুর্গার পায়ে। ফুলের দল মাটিতে পড়লেই, বলিদান আরম্ভ হয়।
এ পুজো এক অদ্ভুত বাঁধনের সাক্ষী। নবখণ্ডের মাজি, চট্টোপাধ্যায় এবং খাঁ পরিবার মিলে একটিই পুজো করে। এক পরিবারের পুজো শরিকি বিবাদে টুকরো টুকরো হয়েছে এবং হচ্ছে, সেখানে এমনটা সত্যিই বিরল। এই পুজোর আরও এক ব্যতিক্রমী ব্যাপার আছে। এখানে দেবীর বিসর্জন স্বপ্নাদেশের উপর নির্ভর করে। স্বপ্নাদেশ পেলেই দেবীর নিরঞ্জন হয়। না পেলে, দেবী থেকে যান। তখন নিত্য পুজো চলে।
বীরভূমের লাভপুরের বাজিকরদের শীতলগ্রামে আবার একেবারে অন্য রকমভাবে অষ্টমীর সন্ধিপুজো হয়। এক-দেড়শো বছর আগে ওড়িশা থেকে স্থানীয় জমিদার বাজিকরদের গ্রামে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর থেকেই তাঁরা রয়ে গিয়েছেন বঙ্গে। সারা বছর বিভিন্ন গ্রামে বাজিকররা ঘুরে ঘুরে নানান ধরনের বাজির খেলা দেখান। শরতে শারদীয়া দুগ্গা পুজোর আয়োজন করেন। অষ্টমী পুজোর দিন সন্ধ্যায় মায়ের থানে সিঁদুর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। উপরে নতুন সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা দেওয়া হয়। তারপর কায়মনবাক্যে চলে প্রার্থনা। তাঁদের বিশ্বাস সাদা কাপড়ে ফুটে উঠবে দেবীর পায়ের ছাপ। ছাপ ফুটে ওঠার পরই শুরু হয় সন্ধিপুজো। আরও এক অদ্ভুত জিনিস রয়েছে এদের পুজোয় মন্ত্রোচ্চারণ হয় বাংলায়।